কাঁদছে কাঁদুক।
ওকে এখানে নিয়ে এসো না। অনেক জায়গা তো।
ভ্যান ভ্যান করিসনা, চুপ করে থাক।
দিলুর চোখ ভিজে উঠলো। এমন বাজে করে কথা বলে কেন আপা? কি করেছে সে? কিছুই তো করেনি। শুধু বলেছে বাবু কাঁদছে। এটা বলা কি দোষের? দিলু কম্বলের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে ফেললো। সেখানে গাঢ় অন্ধকার। বাবুর কান্নার শব্দও সেখানে যাচ্ছে না। অন্ধকার দিলুর ভাল লাগে না। অন্ধকারে তার মৃত্যুর কথা মনে হয়। দাদীজান মারা যাবার সময় থেকেই তার এ রকম হয়েছে। দাদীজান মারা গিয়েছিলেন রাত ন’টায়। সবাই যখন কান্নাকাটি করছে তখন হঠাৎ কারেণ্ট চলে গেলো। কি ভয়াবহ অবস্থা। সবাই কান্না থামিয়ে মোমবাতি মোমবাতি বলে চেঁচামেটি শুরু করলো। দিলু বসে ছিলো সোফায়। হঠাৎ তার মনে হলো দাদীজান যেন উঠে আসছেন তার দিকে। কি অবস্থা। ভাগ্যিস বাবা তখন লাইটার জ্বালিয়ে দিলুর পাশে এসে বসলেন।
নিশাত মৃদুস্বরে ডাকলো—দিলু ঘুমিয়ে পড়েছিস? দিলু জবাব দিলো না। নিশাত কম্বলের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিলুকে কাছে টানলো।
কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা। এত অভিমানি হয়েছে কেন? নিশাতের ইচ্ছা হলো দিলুকে ডেকে তুলে খানিকক্ষণ গল্পগুজব করে। সে আবার ডাকলো—দি দিলু এই পাগলি। দিলুর ঘুম ভাঙ্গলো না। নিশাত ছোট্ট একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। আর ঠিক তখন জামিলের হাসির শব্দ শোনা গেলো। কি আশ্চর্য অবিকল কবিরের মত ঘর কাঁপিয়ে হাসি। জামিল ভাইতো এরকম কখনো হাসেন না। তাঁর সব কিছুই মাপা। এবং কোন কিছুর সঙ্গেই কবিরের কোন মিল নেই। তবু আজ এরকম মিল পাওয়া গেলো কেন? নাকি সব মানুষের মধ্যে অদৃশ্য কোন মিল আছে?
রাত বাড়ছে। বাবু কাঁদছে না। চারদিকে সুনসান নীরবতা নিশাত হাত বাড়িয়ে দিলুকে কাছে টানলো। দিলু ঘুমের মধ্যেই কাঁদছে। কোন মিষ্টি স্বপ্ন দেখছে হয়তো। কতদিন হয়ে গেলো নিশাত কোন মিষ্টি স্বপ্ন দেখে না!
আমার আছে জল – ০৮ম পরিচ্ছেদ
নিশাত খুব ভোরে জেগে উঠলো।
তখনো অন্ধকার কাটেনি। পূবের আকাশ লাল হতে শুরু করেছে। ঘন কুয়াশা চারদিকে। নিশাত দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। মাথার যন্ত্রণা আর নেই। শরীর ঝরঝরে লাগছে। প্রচণ্ড ক্ষিধে। এত ভোরে নিশ্চয়ই আর কেউ জাগেনি।
নিশাত টুথব্রাশ হাতে বারান্দায় হাঁটতে লাগলো। এত সুন্দর বাড়ি। রাতে ঠিক বোঝা যায়নি। নিশাত হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পেছনের দিকে চলে এলো। প্রকাণ্ড পুকুরটি চোখে পড়লো তখন। কুয়াশার জন্যে পুকুরটি পুরোপুরি দেখা যায় না। মনে হয় বিশাল সমুদ্র। পানি দেখলেই ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। নিশাত এগিয়ে গেলো।
এই ভোরেও পাতলা একটা উইণ্ডব্রেকার পরে বাঁধানো ঘাটে সাব্বির বসে আছে। তার পাশেই স্ট্যাণ্ড-ক্যামেরা বসানো। নিশাত বললো—এত ভোরে ক্যামেরায় কার ছবি তুলছেন?
কুয়াশার ছবি। আপনার জ্বর সেরে গেছে?
হ্যাঁ।
নিশাত সিঁড়ি বেয়ে শেষ পর্যন্ত নেমে গেলো। হাত বাড়িয়ে পানিতে আঙ্গুল ডুবালো। তার ধারণা ছিল পানি বরফ-শীতল হবে। কিন্তু তেমন ঠাণ্ডা নয়।
আপনি যেমন বসে আছেন ঠিক তেমনিভাবে বসে থাকুন, আমি আপনার একটা ছবি তুলবো।
অনুমতি প্রার্থনা নয়। যেন আদেশ। নিশাত বললো—মুখ টুথব্রাশ ঝুলতে থাকবে?
হ্যাঁ। থাকুক। আপনি হাত দিয়ে পানি স্পর্শ করছেন। এটাই আমার ছবির থীম।
সাব্বির ক্যামেরা হাতে কয়েক ধাপ নেমে এলো। নিশাতের কি রাগ করা উচিত না, বলা উচিত, এভাবে আমি ছবি তুলি না। কিন্তু নিশাত রাগ করতে পারছে না। কেন পারছে না সেও এক রহস্য। সাব্বির বললো—আজ ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই মনে হচ্ছিলো ছবির জন্যে একটা ভাল কম্পোজিশন পাবো।
আপনি ছবি ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেন না?
ভাবতে পারি হয়তো কিন্তু ছবির কথা ভাবতেই ভালো লাগে।
নিশাত হাসতে হাসতে বললো—আপনার মাথার মধ্যে শুধু কম্পোজিশন ঘুরে তাই না? সাব্বির তার জবাব দিলো না। ক্রমাগত ছবি তুলতে লাগলো। পানিতে হাত ডুবিয়ে বসে রইলো নিশাত। সে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলো—সাব্বির অন্য ফটোগ্রাফারদের মতো নয়। অন্য ফটোগ্রাফাররা বলতো—একটা বাঁ দিকে ফিরুন, একটু হাসুন। মাথাটা একটু উপরে তুলুন। শাড়ির আঁচল টেনে দিন। সাব্বির কিছুই বলছে না। শুধু ছবি তুলছে। নিশাত হাসতে হাসতে বললো—এত ছবি তুলছেন একটা তো ভালো হবেই।
সব সময় হয় না। ছত্রিশটি ছবির মধ্যে যার একটি ছবি ভালো হয় সে একজন বড় ফটোগ্রাফার।
আপনি একজন বড় ফটোগ্রাফার।
হ্যাঁ।
নিশাত লক্ষ্য করলো সে হ্যাঁ বলছে খুব জোরের সঙ্গে। যেন সে মনেপ্রাণে কথাটা বিশ্বাস করে। সাব্বির বললো—যে ছবিটি দিয়ে আমি প্রথম নাম করি তার কথা শুনতে চান?
বলুন।
ছবিটির নাম সরলতা। ইনোসেন্স।
সাব্বির সহজভাবেই নিশাতের পাশে বসলো। যেন দীর্ঘদিনের পরিচিত কেউ পাশাপাশি বসছে।
আমি তখন থাকি নর্থ ডেকোটায়। একবার রুজভেল্ট ন্যাশনাল পার্কে বেড়াতে গিয়েছি। একা একা গভীর বনে ঢুকে পড়লাম। সেখানে দেখলাম ছোট্ট একটা জলা জায়গা। চারদিকে বড় বড় সব উইলি গাছ। উইলি গাছের ছায়া পড়েছে পানিতে। অপূর্ব পরিবেশ। এবং সেই অপূর্ব পরিবেশে অল্প বয়সী একটি মেয়ে লাঞ্চবক্স হাতে নিয়ে বসে আছে। ওর বন্ধুটি বোধ হয় কাছেই কোথাও গেছে। আমি মেয়েটিকে বললাম—তোমার কয়েকটি ছবি তুলতে চাই। সে সঙ্গে সঙ্গে রাজি। আমি বললাম—তুমি কি ঘুমিয়ে পড়ার মত একটা ভঙ্গি করতে পার? সে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো। অসংখ্য ছবি তুললাম, কিন্তু মনে হলো কোথায় যেন একটা ফাঁক রয়ে গেছে। ছবিটিও অসম্পূর্ণ। ঠিক তখন একটা বুনো প্রজাপতি এসে বসলো লাঞ্চবক্সে, তৈরী হয়ে গেলো ছবি। বিখ্যাত ছবি।