নিশাত, ওকে শুইয়ে দিয়ে এসেছি।
থ্যাংকস।
তোমার জ্বর কেমন?
আমার জ্বরের খবর মনে হচ্ছে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
জামিল তাকালো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। মৃদুস্বরে বললো—বেড়াতে এসে অসুখে পড়াটা খুব খারাপ।
আমি বেড়াতে-টেড়াতে আসিনি। সবাই এসেছে, বাধ্য হয়ে আমিও এসেছি।
জামিল হালকা স্বরে বললো, অবস্থা এরকম হবে জানলে আমি তোমার সঙ্গে জুটতাম না।
জুটছেন কেন, আপনাকে তো কেউ সাধাসাধি করেনি। নাকি করেছে?
না করেন। আমি নিজ থেকেই এসেছি।
কেন এসেছেন?
নিশাত, তোমার শরীর ভালো না। যাও তুমি শুয়ে থাক।
না, আপনি আমাকে বলুন আপনি কেন এসেছেন? ইউ গট টু টেল মি দ্যাট!
জামিল একটা সিগারেট ধরালো। সে লক্ষ্য করলো—নিশাত অল্প অল্প কাঁপছে।
জামিল ভাই, আমি আপনাকে আগেও পছন্দ করিনি, এখনো করিনা। আমার মনে হয় আপনি সেটা জানেন না।
নিশাত, যাও ঘুমুতে যাও।
ওসমান সাহেব অবাক হয়ে উঠে এলেন—এই নিশাত কি হয়েছে?
কিছু হয়নি বাবা।
জামিলকে কি বলছিলি?
কিছু বলছিলাম না।
নিশাত ক্লান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে চলে গেলো। ওসমান সাহেব বললেন—জামিল, ও চেঁচামেই করছিলো কেন?
জানি না চাচা। আপনি এখনো বারান্দায় বসে আছেন কেন? ঠাণ্ডা লাগবে তো।
ঠাণ্ডা অলরেডি লেগে গেছে। কিন্তু অন্ধকারে বসে থাকতে ভালোই লাগছে। জামিল, তুমি একটা কাজ করতো, দেখ, আলিমকে কোথাও পাও কিনা। আর শোন, এই হ্যাজাকটা এখান থেকে সরাবার ব্যবস্থা কর। আলো চোখে লাগছে। তোমাদের খাওয়া-দাওয়া হয়েছে তো?
হয়েছে।
সাব্বির কোথায়? ওকে এখানে আসার পর একবারও দেখিনি।
উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন।
আলিম ওসমান সাহেবের সামনে তাঁর প্রিয় গ্লাসটি রাখলো। লম্বা গ্লাস। জার্মান ক্রিস্টালের অপূর্ব গ্লাস। এই গ্লাস ছাড়া অন্য কিছুতেই তিনি তৃপ্তি পান না। ওসমান সাহেব স্পষ্ট একটা সুখের নিঃশ্বাস ফেললেন। আলিম মনে করে এনেছে। আলিম দ্বিতীয়বার একটা বাটিতে একগাদা বরফ নিয়ে এলো।
আরে তুই বরফ পেলি কোথায়?
আসার সময় নেত্রকোণা থেকে বিশ সের বরফ কিনলাম।
বলিস কি। গলে নাই?
কাঠের গুঁড়া দিছি চাইর দিকে। তবু গলছে। এখন আছে অল্প।
আলিম খুব সাবধানে হোয়াইট হর্সের বোতল খুলে হুইস্কি ঢাললো। ওসমান সাহেবের পেগ সাধারণ পেগের চেয়ে একটু বড়। আলিম মাপটা জানে। তবু অন্ধকারে কিছু বেশী পড়লো। অন্য সময় হলে ধমকে দিতেন। আজ কিছুই বললেন না। বরফের ব্যাপারটা তাঁকে অভিভূত করেছে।
তোর দাঁতের ব্যথার কি অবস্থা?
ব্যথা আছে।
রেহানার কাছ থেকে নিয়ে তিনটা এ্যাসপিরিন খা ব্যথা কমে যাবে।
আলিম কথা বললো না। ওসমান সাহেব দরাজ গলায় বললেন—তোর এখানে থাকার দরকার নেই। যা শুয়ে পড়।
স্যার আপনে ঘরে বসেন বাইরে ঠাণ্ডা।
বাইরেই ভালো। শোন আলিম, দু’টা পানির বোতল আর কিছু বরফ দিয়ে যাস।
আচ্ছা।
আলিম চলে যেতেই বিদ্যুতের মত ওসমান সাহেব দিলুর ধাঁধার রহস্য ভেদ করলেন। অত্যন্ত সহজ উত্তর। বরফ। দশ সের পানিকে প্রথমে জমিয়ে বরফ করতে হবে। তারপর সেই বরফের টুকরোটি হাতে করে যেখানে যাবার সেখানে যেতে হবে।
ওসমান সাহেব গভীর আনন্দ বোধ করলেন। নীলগঞ্জ ডাকবাংলোটি তাঁর কাছে হঠাৎ করে বড় প্রিয় হয়ে গেলো। যেন তিনি জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়াটি এই ডাকবাংলোয় পেয়ে গেলেন। যেন তাঁর আর কিছু পাওয়ার নেই। জীবনের সমস্ত সাধ পূর্ণ হয়েছে।
বাবা!
দিলু একটি কম্বল গায়ে জড়িয়ে উঠে এসেছে, শীতে কাঁপছে অল্প অল্প। কি রে দিলু?
তুমি এখানে বসে কি করছ?
কিছু করছিনা। বসে আছি।
আমার ঘুম আসে না বাবা। তোমার সঙ্গে একটু বসি?
বোস।
হুইস্কি খাচ্ছ, না? মা জানলে খুব রাগ করবে।
ওসমান সাহেব একটি হাত মেয়ের পিঠের ওপর রাখলেন। দিলু হালকা স্বরে বললো—বাবা, চা চামুচ দিয়ে এক চামুচ দেখি? আমার খুব খেতে ইচ্ছে করে।
ওসমান সাহেব একবার ভাবলেন বলবেন—যা একটা চামুচ নিয়ে আয়। বলতে পারলেন না।
দিলু বললো—তোমার শীত করছে না?
করছে। তোর মা কি ঘুমিয়ে পড়েছে?
হ্যাঁ। সবাই ঘুমুচ্ছে। শুধু আমরা দু’জনে জেগে আছি।
জায়গাটা কেমন লাগছে?
ভাল।
পুকুরটা দেখেছিস?
হুঁ।
বিরাট পুকুর তাই না?
হুঁ। এ রকম একটা বাড়ি আমাদের থাকলে খুব ভাল হতো—তাই না বাবা? পেছনে বিরাট একটা পুকুর থাকবে। সামনে থাকবে প্রকাণ্ড সব রেণ্টি গাছ।
এগুলা রেণ্টি গাছ নাকি?
হুঁ।
কে বলেছে?
জামিল ভাই বলেছেন।
দিলু ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললো তারপর খুব হালকা গলায় বললো—আপা আমার সঙ্গে আজ খুব খারাপ ব্যবহার করেছে।
আমরা সবাই কখনো না কখনো খারাপ ব্যবহার করি।
কেউ আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে আমার খুব কষ্ট হয়। আমি তো কারোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি না। করি? তুমি বল?
ঘুমুতে যা দিলু।
দিলু উঠে গেলো। ওসমান সাহেবের হঠাৎ মনে পড়লো, আরে তাই তো, ধাঁধার উত্তরটা তিনি জানেন এটা দিলুকে বলা হলো না। উঠে গিয়ে ডাকবেন নাকি? কিন্তু তাঁর উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
দিলু ঘুমিয়েছে নিশাতের সঙ্গে। প্রকাণ্ড একটা খাট। খাটের নীচে আলো কমিয়ে হ্যারিকেনটা রাখা। ঘরময় অবছা অন্ধকার। পায়ের দিকের জানালার একটা কাঁচ ভাঙ্গা। সেই ভাঙ্গা গলে শীতের হাওয়া আসছে। দু’টি কম্বল আছে গায়ে তবু শীত মানছে না। দিলু নিশাতের দিকে আরো একটু সরে এলো। নিশাত শীতল স্বরে বললো—গায়ের উপর এসে পড়ছো কেন দিলু? সরে শোও। এত ঘেঁষাঘেঁষি আমার ভালো লাগে না। দিলু অনেকখানি সরে গেলো। পাশের ঘরে বাবু কাঁদছে। বিড়বিড় করে কি সব যেন বলছে। বোঝা যাচ্ছে না। দিলু বললো—আপু বাবু কাঁদছে।