হুঁ।
দরজা ভালো করে বন্ধ করে ঘুমাবে। রান্নাঘরে গিয়ে দেখলে গ্যাসের চুলা বন্ধ করা হয়েছে কিনা।
আচ্ছা।
মাছের চৌবাচ্চায় সিগারেটের টুকরা মেললে না।
আচ্ছা।
প্রতিদিন না করি তারপরেও তো ফেল।
আর ফেলব না।
চিত্রার বিয়ে তো ঠিক হয়ে গেল। এই বৃহস্পতিবারে এনগেজমেন্ট। দয়া করে বাসায় থেকো। ঐ দিন আবার ভাই০বোনদের বাসায় রওনা হয়ো না। তোমার একমাত্র কাজই তো আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে বাড়িতে ফকিরের মতো ঘুরে বেড়ানো। চিত্রার এনগেজমেন্টের দিন তুমি অফিসের দু-একজন কলিগকে বলতে চাইলে, বলতে পার। তাই বলে অফিস শুদ্ধ সবাইকে নিয়ে এসো না।
আচ্ছা।
টেলিফোন রাখলাম। চিত্রাকে কিছু বলবে?
না থান।
মেয়েকে অভিনন্দন দাও। ধর আমি চিত্রাকে দিচ্ছি।
রহমান সাহেব অনেকক্ষণ টেলিফোন ধরে বসে রইলেন। চিত্রা বোধহয় দূরে কোথাও ছিল। রহমান সাহেব কিছুতেই ঠিক করতে পারলেন না মেয়েকে কি বলবেন। চিত্রা তোমাকে বিয়ে ঠিক হবার কারণে অভিনন্দন এই ধরনের কথা কি মেয়েকে বলা যায়? এতো মহাবিপদ।
হ্যালো বাবা।
হ্যাঁ।
তোমার একটা চাইনিজ পাওনা রইল। একদিন শুধু তুমি আর আমি চাইনিজ শেয়ে আসব।
কবে?
তুমি যেদিন বললে সেদিন। তুমি যদি আগামীকাল যেতে চাও। আগামীকালই নিয়ে যাও। যাবে আগামীকাল?
আচ্ছা।
টেলিফোন রাখি বাবা? আর কিছু বললে?
না।
যাও ঘুমিয়ে পড়।
আহা।
রহমান সাহেবের খুব আনন্দ লাগছে। জ্বর জ্বর ভাব পুরোপুরি চলে গেছে। জইতরীর মা টিভি দেখছে। তাঁর ইচ্ছা করছে জইতরীর মা’র সঙ্গে বসে টিভি দেখতে।
রহমান সাহেব বললেন, জইতরীর মা তোমার পানের বাটা থেকে একটা পান বানিয়ে দাও তো। আর শোন আগামীকাল রাতে আমার জন্যে কিন্তু রান্না করবে না। আমি বাইরে খাব। আমার দাওয়াত আছে।
জ্বে আচ্ছা। পানে জর্দা দিমু?
হ্যাঁ দাও। বেশি দিও না।
তিনি পান খেলেন। পানের সঙ্গে সিগারেট খেলেন। জইতরীর মার সঙ্গে গানের অনুষ্ঠান দেখলেন। ঘুমুতে যাবার আগে দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখেন বৃষ্টি থেমে গেছে। মেঘের ফাঁকে চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় ভেজা বাগানবিলাসের পাতা চকচক করছে। মনে হচ্ছে চাঁদের আলো আঠার মতো গাছের গায়ে লেগে গেছে।
মাছের চৌবাচ্চার পাশে কে যেন বসে আছে। সিগারেট টানছে। সিগারেটের আগুন উঠছে নামছে। তাঁর দিকে পেছন দিয়ে বসেছে বলে তিনি মুখ দেখতে পাচ্ছেন না। রহমান সাহেব দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে এলেন। চৌবাচ্চার পাশে দাঁড়ানো মানুষটা তার পায়ের শব্দ পেয়েই চমকে উঠে দাঁড়াল।
কে?
চাচাজি আমি মজনু।
ও আচ্ছা তুমি। কি করছ?
কিছু করছি না চাচাজি।
রহমান সাহেব মানুষটাকে চিনতে পারছেন না। তবুও পরিচিত মানুষের মতো কথা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার ধারণা কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি চিনতে পারবেন। তাঁর এই সমস্যা আগে ছিল না। কিছুদিন হলো হচ্ছে। পরিচিত মানুষদেরও তে সময় লাগে। তবে শেষ পর্যন্ত চিনতে পারেন।
ছেলেটাকে এখন নিলেন। ভাড়াটে নিজাম সাহেবের চাচাতো ভাই। তাদের সঙ্গেই থাকে। বছর দুই আগে চাকরির খোঁজে এসেছিল। চাকরি হয় নি। সে এই বাড়িতেই আছে। নিজাম সাহেবের যাবতীয় কাজ করে দেয়। বাজার করা, ইলেকট্রিসিটি বিল দেয়া, ঘর মুছে দেয়া–সব কাজেই সে পারদর্শী। রোজই যে ছেলের সঙ্গে দেখা হয় তাকে চিনতে না পারায় রহমান সাহেবের খুবই অবাক লাগল।
তুমি একটু আগে সিগারেট খাচ্ছিলে না?
মজুন জবাব দিল না। মাথা নিচু করে বইল। রহমান সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরাটা তুমি চৌবাচ্চায় ফেলেছ তাই না?
জ্বি।
একটা রহস্যভেদ হলো বুঝলে বাবা, চিত্রার মার ধারণা আমি এই চৌবাচ্চায় সিগারেট ফেলতাম। অথচ আমি ফেলতাম না। রোজ সকালে সিগারেটের করা দেখা যেত। তখন আমি কি ভাবতাম জান? আমি ভাবতাম আমিই সিগারেট ফেলে ভুলে যাচ্ছি। ইদানীং আমার ভুলে যাওয়া রোগ হয়েছে। শুরুতে তুমি যে কথাবার্তা বলছিলে— আমি তোমাকে চিনতে পারছিলাম না। তুমি বললে না— তোমার নাম মজনু। আমি ভাবছিলাম, কোন মজনু? বাবা তুমি কি খাওয়া দাওয়া করেছ?
মজনু চুপ করে রইল।
রাত বারটার মতো বাজে। এখনো না খেয়ে আছ। যাও খেয়ে শুয়ে পড়।
মজনু নিচু গলায় বলল, ভাত খাব না চাচাজি।
খাবে না কেন?
ভাইজানের বাসায় যেতে ভয় লাগছে।
কেন?
ভাইজান সাড়ে তিন হাজার টাকা দিয়ে আমাকে এক জায়গায় পাঠিয়েছিল। টাকাটা হাইজ্যাকাররা নিয়ে গেছে। উনাকে এটা কি ভাবে বলব বুঝতে পারছি। না। উনি বিশ্বাস করলেন না। উনি ভাববেন–টাকাটা আমি মেরে দিয়েছি।
তা মনে করলেন কে?
ভাইজান আমাকে বিশ্বাস করে না। চাচাজি আমি খুবই গরিব কিন্তু এইসব কাজ আমি করি না।
বিশ্বাস না করলে না করবে তাই বলে ভাত না খেয়ে থাকবে নাকি? যাও সব খুলে বল। তারপর খাওয়া দাওয়া কর। তোমাকে তো আর না খাইয়ে রাখবে না।
আচ্ছা যাই। এমন ক্ষিধা লেগেছে চাচাজি। ক্ষিধার চোটে মাথা বেদনা শুরু হয়েছে। চাচাজি আমার জন্যে একটু দোয়া করবেন।
অবশ্যই দোয়া করব। অবশ্যই করব।
আমার জন্যে একটা চাকরির চেষ্টাও দেখবেন চাচাজি। আমি ইন্টারমিডিয়েট পাস। দশ নম্বরের জন্য ফাস্ট ডিভিশান পাই নাই। এস.এস.সি তে ফাস্ট ডিভিশন ছিল— জেনারেল অংকে লেটার মার্ক ছিল। যে কোনো চাকরি আমি করল চাচাজি–পিওনের চাকরি, দারোয়ানের চাকরি। ক্লাস টু-থির ছাত্রদের প্রাইভেট পড়াতে পারব। একটু চেষ্টা নিবেন চাচাজি। খুব কষ্টে আছি।