না রাগ করছি না।
রাগ করলেও আমার মনের কথা আমি বলবই। নিজের ভাইকে না বললে কাকে বলব? ভাইয়া চিত্রার যে ছেলের সঙ্গে বিয়ের কথা হচ্ছে সে নাকি বিরাট মালদার পার্টি। জাহাজের মালিক। বিদেশেই থাকে। হঠাৎ হঠাৎ দেশে আসে।
আমি কিছুই জানি না। ফরিদা আজকে উঠি। আমার শরীরটাও ভালো না।
কী হয়েছে তোমার?
মাঝে মাঝে মাথায় খুব যন্ত্রণা হয়।
তোমাকে দেখেই মনে হচ্ছে তোমার শরীর খারাপ। চুল সব পেকে গেছে। তুমি বুড়ো হয়ে গেছ। ভিটামিন খাও ভাইয়া। বাবুর বাবা রোজ সকালে কি একটা ভিটামিন খায় ওর স্বাস্থ্য দেখ কত ভালো। এম.পির শালার ড্রাইভারকে এক থাপ্পড় দিয়েছিল এতেই ড্রাইভারের গাল বেঁকে গেছে।
রহমান হাসলেন।
ফরিদা রাগী গলায় বলল, তুমি হাসবে না। হাসির কোনো কথা না। আমি ভিটামিন ফাইলটা নিয়ে আসছি। তুমি নিয়ে যাও। ওকে বলব আরেক ফাইল কিনে নিতে।
লাগবে না। তুই নাম বল আমি কিনে নেন।
তুমি জন্মেও কিনবে না। তোমাকে আমি চিনি না। ফাইলটা নিয়ে যাও।
ফরিদা ভিটামিনের ফাইল এনে রহমান সাহেবের হাতে দিতে দিতে বলল। ভাইয়া তুমি এতক্ষণ ছিলে একবারও তো বাবুর খোঁজ করলে না। অথচ এই ছেলে বড়মামা বলতে পাগল।
বাবু ঘুমাচ্ছে নাকি?
না ও গেছে তার টাটার বাসায়। ওদের কম্পিউটার আছে। কম্পিউটারে গেম খেলতে গেছে। বাবুর একটা কম্পিউটারের এত শখ। অথচ এটাই দিতে পারছি না। ঘরে একটা কম্পিউটার থাকলে কত জ্ঞান হয়। ভাইয়া একটু চেষ্টা করে দেখ তো— লোনে কম্পিউটার কেনা যায় কিনা। মাসে মাসে লোন শোধ দিতাম।
আমার তো এরকম পরিচিত কেউ নেই।
তারপরেও একে ওকে জিজ্ঞেস করে দেন। আমি তো আর তোমাকে কিনে তো বলছি না। মানুষের কাছ থেকে চেয়ে চিন্তে উপহার নয়। আমার স্বভাবের মধ্যে নেই।
রহমান সাহেব বাড়ি ফিরলেন কাক ভেজা হয়ে। বাস থেকে অনেকটা পথ বৃষ্টিতে হাঁটতে হয়েছে। রিকশা ছিল, পাঁচ টাকা ভাড়ার জায়গায় সব রিকশাই চাচ্ছে পনেরো টাকা। একজন চাইল কুড়ি টাকা। তিনি বৃষ্টিতে ভিজেই রওনা হলেন। আষাঢ় মাসের বৃষ্টিতে ঠাণ্ডা লাগে না, শ্রাবণ মাসের বৃষ্টিতে গায়ে কাঁপন ধরে যায়। বাড়ির কাছাকাছি এসে তাঁর মানে হলো জ্বর এসে যাচ্ছে। দাঁতে দাঁত লেগে ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে। খুব ক্ষিদেও লেগেছে। ইলিশ মাছ গরম গরম ভেজে দিলে এক গামলা ভাত খেয়ে ফেলা যেত।
বাড়িতে কেউ নেই। কাজের বুয়া জইতরীর মা আয়োজন করে টিভি দেখছে। সামনে পানের বাটা। রাহমান সাহেবকে দেখে জইতরীর মা বলল, খালুজান বাড়িত কেউ নাই। রহমান সাহেব বললেন, আচ্ছা।
তারা হেই সইন্ধ্যাকালে গেছে। অখন রাইত বাড়ে দশটা। টিভির খবরও শেষ।
রহমান সাহেব আবারো বললেন, আচ্ছা।
বাড়িতে কেউ নেই শুনে তিনি শান্তি বোধ করছেন। তাঁকে কৈফিয়ত দিতে হবে না, কেউ কঠিন গলায় জানতে চাইবে না বাড়ি ফিরতে এত রাত হলো কেন? বৃষ্টিতে ভেজার দরকার পড়ল কেন?
জইতরীর মা, আজ রান্না কি?
ডিমের সালুন, কুমড়া ভাজি, ডাইল।
ভাত দিয়ে দাও। আমি গোসল করে আসি। পায়ে নোংরা পানি লেগেছে।
গরম পানি দিব খালুজান? চুলাত পানি গরম আছে।
আচ্ছা দাও।
আম্মারার জন্যে চিন্তা লাগতাছে লালুজান। সইন্ধ্যাকালে গেছে অখন বাজে দশটা। দেশের অবস্থা ভাল না।
রহমান সাহেব কিছু বললেন না। তোয়ালে হাতে বাথরুমের দিকে রওনা হলেন। স্ত্রী কন্যাদের জন্যে তাঁর কেন কোনো দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে না, এটা ভেবে সামান্য চিন্তিত বোধ করলেন। তার ইচ্ছা করছে না খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিছানায় শুয়ে পড়তে। বৃষ্টির রাতে ঘুমটা আরামের হবে। যদিও ঘুমানো ঠিক হবে না। ওদের ফিরে আসা পর্যন্ত জেগে থাকতে হবে।
রহমান সাহেব গরম পানি দিয়ে আরাম করে গোসল করলেন। ভাতও খেলেন আরাম করে। তার পকেটে রাখা সিগারেটের প্যাকটা ভিজে ন্যাতা ন্যাতা হয়ে গিয়েছিল, জইতারীর মা চুলার পাশে রেখে সেই ন্যাতা ন্যাতা সিগারেট ও ঠিক করে ফেলল। তিনি আরাম করে সিগারেট ধরালেন। তার নিজেকে একজন মুখী মানুষ বলে মনে হতে লাগল। জর্দা দিয়ে একটা পান খেতে পারলে ভালো হতো। অফিসে দুপরে খাবার পর সব সময় একটা পান খান। কিন্তু এ বাড়িতে পান খাওয়া নিষেধ। শালা পান চিবানো দেখতেই পারে না। এ বাড়িতে শুধু জইতরীর মার পান খাওয়ার অনুমতি আছে।
খালুজান আফনের টেলিফোন। ছোট আফা টেলিফোন করছে।
রহমান সাহেব ভয়ে ভয়ে টেলিফোন ধরতে গেলেন। বাড়ির কেউ টেলিফোন করছে শুনলেই তার ভয় ভয় লাগে। নিজেকে অপরাধী অপরাধী মনে হয়। যেন টেলিফোনে তার কাছে কেউ কৈফিয়ত তলব করবে।
হ্যালো বাবা।
হ্যাঁ।
আমরা বাইরে খেতে এসেছিলাম। সেখান থেকে বড়খালার বাসায় গিয়েছি। বড়খালা ছাড়ছে না। আমরা রাতে এখানে থেকে যান।
আচ্ছা।
আপার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তারিখও হয়ে গেছে। সেপ্টেম্বরের সাত তারিখ— শুক্রবার।
আচ্ছা।
আমরা ভেবেছিলাম ওরা বোধহয় No করে দেবে। তুমি কি ভেবেছিলে ইয়েস না নো।
বিয়ের কথাবার্তা আলাপ আলোচনার কিছুই রহমান সাহেব জানেন না। তারপরেও বললেন— ইয়েস ভেবেছিলাম।
আমিও ইয়েস ভেবেছিলাম। আপাকে কেউ দেখলে আর পছন্দ করবে না এটা হতেই পারে না। বাবা তুমি মার সঙ্গে কথা বল।
শায়লা গম্ভীর গলায় বললেন, তুমি কখন বাসায় এসেছ?
রহমান সাহেব মিনমিন করে বললেন, আজ একটু দেরি হয়েছে।
এটা তো নতুন কিছু না। দেরি তো রোজই হচ্ছে। চিত্রা তার স্কলারশিপের টাকায় আজ আমাদের খাওয়াল। তোমাকেও নিয়ে যেতে চাইছিল। তুমি তো রাত দশটার আগে বাসাতেই ফের না। কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াও কে জানে। ভাত খেয়েছ?