রহমান সাহেবের বাড়িতে এই মাছটা রান্না হয় না। কারণ চিত্রা ইলিশ মাছের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। গায়ে জ্বর নিয়ে একবার ইলিশ মাছ খেয়ে বমি করেছিল, তারপরই মাছের গন্ধটা তার মাথায় ঢুকে গেছে। সে বলে দিয়েছে যদি ইলিশ মাছ রাধতেই হয়, সে যখন বাসায় থাকবে না, তখন যেন রান্না হয়। লায়লা বাড়িতে এই মাছ আনাই বন্ধ করে দিয়েছেন।
সিজনের জিনিস সিজনে খেতে হয়। কমলার সিনে একটা কমলার কোয়া হলেও মুখে দিতে হয়। জলপাইয়ের সিজনে লবণ মাখিয়ে একটা জলপাই খেতে হয়। বর্ষা হল ইলিশের সিজন। বর্ষায় সর্ষে বাটা দিয়ে একবার ইলিশ না খেলে কিভাবে হয়? তবে ভালো ইলিশ এখন চার-পাঁচশ টাকার কমে পাওয়া। যায় না। আর এই টাকার ব্যবস্থাটাও হঠাৎ করে হয়ে গিয়েছে। রহমান সাহেব তার অফিসের ড্রয়ারে খুচরা টাকা রাখেন, বেশি না সামান্যই। দু টাকার কিছু নোট, পাঁচ-দশ টাকার কয়েকটা নোট। সেখান থেকে সিগারেট কেনার টাকা দিতে গিয়ে দেখেন পাঁচশ টাকার একটা দলা পাকানো নোট। তিনি নিজেই দলা পাকিয়েছেন। (মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে দলা পাকানো তার স্বভাব। মাঝে মাঝেই কাজটা করেন। কেন করেন নিতে জানেন না।) তিনি দলাপাকানো নোট নিয়ে সোজা করে দেখেন একটা পাঁচশ টাকার নোট। ইলিশ মাছ কেনার চিন্তাটা তখনি তার মাথায় আসে। মাছ কিনতে হবে, সরিষা কিনতে হবে। পুরনো সরিষার ঝাঝ বেশি, কিন্তু তিতকুটে ভাব আছে। নতুন সরিষা কিনতে হবে। কাঁচামরিচ কিনতে হবে। রান্নার সময় দেখা যাবে বাসায় কাঁচামরিচ নেই। পুঁই শাকের বড় পাতা পাওয়া গেলে খুব ভালো হয়। ইলিশের পাতুড়ি রান্না করা যায়। তার অতি প্রিয় খাবারের একটি। এক হালি কাগজি লেবুও কেনা দরকার। কাগজি লেবুর সুঘ্রাণ মিশিয়ে পাতুড়ি খাবার আনন্দই অন্য রকম।
সব বাজার সারতে রাত নটা বেজে গেল। রহমান সাহেবের মনে হলো— এত রাতে ইলিশ মাছ নিয়ে গেলে রান্না হবে না। শায়লা অবশ্যই মাছটা ফ্রিজে রেখে দেবে। তার সময় সুযোগ অনুসারে ফ্রিজ থেকে বের হবে। রহমান সাহেব ঠিক করলেন তিনি মাছটা নিয়ে তার ছোটবোন ফরিদার বাসায় চলে যাবেন। সে থাকে কলাবাগানে। তার রান্নার হাত খুবই ভালো। তাকে বললেই হবে— তোর জন্যে মাছ এনেছি। তুই তো পাতুড়ি খুব ভালো রান্না করিস। দেখি রান্না কর। সরিষা, কাঁচামরিচ সবই আছে। পুঁই পাতাও এনেছি।
ফরিদা খুব আগ্রহ করে রান্না করবে এবং বলবে—ভাইয়া খেয়ে যাও। না খেয়ে গেলে রান্না করা মাছ আমি নর্দমায় ফেলে দেব। তোমার চোখের সামনেই ফেলব। আমাকে তো তুমি চেন না। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, বাড়িতে রান্না করেছে। ওরা না খেয়ে বসে থাকবে। ফরিদা বলবে, থাকুক না খেয়ে বসে। একবেলা বোনের সঙ্গে খেলে ভাবী কি তোমাকে শাস্তি দেবে? কানে ধরে ওঠবোস করালে? বোনের কথায় না পেরে তিনি নিতান্ত অনিচ্ছায় রাজি হবেন। বলবেন, আচ্ছা ঠিক আছে। খেয়েই যাই।
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তিনি ফরিদার বাসায় উপস্থিত হলেন। ফরিদা গরম চাদর গায়ে জড়িয়ে দরজা খুলল। তার চোখ মুখ লাল, চুল উসগু-গুসকু। তিনি বললেন, কি হয়েছে রে?
ফরিদা বলল, আর এসেছে। সকাল থেকে বুকে ব্যথা করছে। ওকে বললাম, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। ও বলল ডাক্তারের বিকালে চেম্বারে বসে। আমি সন্ধ্যাবেলা নিয়ে যাব। এখন বাজে সাড়ে নটা। সাহেব এখনো ফিরেন নাই।
বুকে ব্যথা কী বেশি?
দুপুরে বেশি ছিল, এখন কম। পানি খেলে ব্যথাটা কমে। চার-পাঁচ বালতি পানি খেয়ে ফেলেছি।
জহির গেছে কোথায়?
মনে হয়, তাস খেলতে গেছে। তাসের নেশা হয়েছে, রোজ সন্ধ্যায় বন্ধুর বাসায় তাস খেলতে যায়। আমার ধারণা পয়সা দিয়ে খেলে।
বলিস কী?
ফরিদা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, কতরকম যথার মধ্যে যে আছি তোমাকে কি বলব। বলতে লজ্জাও লাগে। ব্যাগে কি মাছ?
রহমান সাহেব ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুই ইলিশ মাছ ভালো রাধিস। তোর জন্যে একটা মাছ নিয়ে এলাম। মাছটা টাটকা–এক্ষুণি বেঁধে ফেল। টাটকা মাছের স্বাদই অন্যরকম।
এখন মাছ রাধতে পার না ভাইয়া। রান্না বান্না আমার মাথায় উঠেছে। কত কিছু যে ঘটেছে তুমি তো জানই না। বাবুর বাবাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। একরাত ছিল হাজতে।
বলিস কী?
রিকশা করে যাচ্ছিল পেছন থেকে একটা প্রাইভেট কার এসে রিকশায় ধাক্কা দেয়। সে রিকশা থেকে নেমে তার স্বভাব মতো গাড়ির ড্রাইভারকে টেনে বের করে চড় থাপ্পড় দেয়। গাড়িটা হলো সরকারি দলের এমপির। এম.পি সাহেবের শালা গাড়িতে বসে ছিল। বুঝতেই তো পারছ এম. পির শালা তো সহজ জিনিস না। এদের হম্বিতম্বি হয় মন্ত্রীদের মতো। এম.পির শালার কারণে পুলিশ বাবুর বাবাকে এরেস্ট করে হাজতে নিয়ে গেল। জননিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে দিবে এমন অবস্থা। শেষে মন্ত্রী-টন্ত্রী ধরে ছাড়া পেয়েছে। গাড়ির ড্রাইভারের পায়ে ধরে তাকে মাফ চাইতে হয়েছে। কি লজ্জা বলতো ভাইয়া।
লজ্জা তো বটেই। তোর শরীরটা খারাপ তুই বিশ্রাম কর। আমি উঠি।
চা না খেয়ে যেতে পারবে না। চা খাও।
আরেকদিন এসে খাব।
আচ্ছা ঠিক আছে আরেকদিন এসে খেও—এখন বসতে বলছি বোস। তোমার তোর বিয়ের কথাবার্তা নাকি হচ্ছে?
জানি না তো।
কি বল জানি না। জানো ঠিকই বলবে না। তোমার কি ধারণা আমাদের। বললে আমরা বিয়ে ভাঙিয়ে দেব?
ছিঃ ছিঃ কি বলছিস তুই।
কিছু মনে করো না ভাইয়া। যা বললাম, মনের দুঃখে বললাম। তোমাদের কোনো ব্যাপারেই তো এখন আমরা নেই। বাবুর জন্মদিন করলাম, ভাবীকে তোমার দুই মেয়েকে আমি নিজে গিয়ে বলে এলাম–তুমি ঠিকই এলে ভাবী এল না। মেয়ে দুটাকে পাঠাতে পারত, তাও পাঠাল না। হয়তো আমরা তোমার মেয়ের বিয়েতে দাওয়াতও পাব না। বাবুর বাবা গরিব তো! এই জন্যে এ অবহেলা। বড়লোক হতো, পাজেরো গাড়ি থাকত–ঠিকই ভাবী দুই মেয়েকে নিয়ে বাবুর জন্মদিনে আসত। ভাইয়া আমার কথায় রাগ করছ না তো?