শালা টেলিফোন নামিয়ে রেখে মাছের চৌবাচ্চার কাছে গেলেন। দুটা মাছ তে ভেসে থাকার কঙ্কা। কোনো মাছ মরে ভেসে নেই। শায়লার চোখে পানি। সে। বৃষ্টি ভালোই পড়ছে। আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে পুরো ভিজে যেতে হবে। চিত্রা দন্না ধরে দাঁড়িয়েছে। সেখান থেকেই চেচিয়ে বলল, মা তুমি ঞ্চি মত পাল্টেই? আমরা কি আজ বাইরে খেতে যাব?
শায়লা বললেন, হ্যাঁ যাব। দুই মিথ্যা কথাগুলি কেন বললি?
চিত্রা বলল, তুমি এত আপসেট হয়েছিলে দেখে মজা লাগল। তুমি সত্যটা জেনে যাতে অনেক বেশি আনন্দ যাতে পাও সেজন্যেই মিথ্যা বানিয়ে বললাম। মা তুমি তো ভিজে যাচ্ছে। উঠে আস।
শায়লার বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগছে। তার মনে হচ্ছে তিনি কৈশোরে ফিরে গেছেন। তখন তারা থাকতেন ময়মনসিংহে। বৃষ্টি নামলেই বৃষ্টিতে ভেজা ছিল তার প্রধান শথের একটি। ময়মনসিংহ শহর থেকে চলে আসার পর আর ইচ্ছা করে বৃষ্টিতে ভেজা হয় নি।
বৃষ্টি আসার মুখে চিলার বাবা নিউমার্কেটের কাঁচাবাজারে ঢুকে পড়লেন। কাঁচাবাজারে ঘুরতে তার ভালো লাগে। প্রথম কিছুক্ষণ তিনি সব্জি দেখেন। কলার থোড় হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখেন। একটা পাতা উঁচু করে ভেতরটা দেখেন। ফুলগুলি সোনালি আছে কিনা, থোড় কেনার সময় এটাই বিবেচ্য। সজনে ডাটা হাতে নিয়ে। দোকানি দেখতে না পায় এমনভাবে লুট করে সজনে ডাটার মাথা ভেঙে গন্ধ শুকেন। গাছ থেকে সদ্য পেড়ে আনা ডাটার প্রাণ এক রকম আর সাত দিনের বাসি চিমসে ধরা সজনের ঘ্রাণ অন্য রকম। তার আগ্রহ সবচে বেশি ক্যাপসিকামে। এই সব্জি তিনি আগে কখনো খান নি। মরিচ মরিচ গন্ধ, আবার ঠিক মরিচও না। তিনি কাঁচাবাজারে যখনই ঢুকেন তখনি এই সব্জিটা কিনতে ইচ্ছে করে। পনেরো টাকা পিসের সব্জি কেনা সম্ভব না। তারচেয়েও বড় ভয় লায়লা রাগ করবে। নতুন কিছু নিয়ে গেলেই শায়লা রাগ করে। একবার তিনি এক কেজি মেটে আলু নিয়ে গেলেন। শায়লা বলল, কি এনেছ তুমি। জিনিসটা কি? দেখতে এত কুৎসিত।
তিনি মিনমিনে গলায় বললেন, মেটে আলু।
মেটে আলুর নাম জীবনে শুনি নি। এটা কী বস্তু?
জংলি আলু। চাষ করতে হয় না, বনে বাদাড়ে আপনাতেই হয়। খেতে ভালো।
আমাদের জংলি আলু খেতে হবে কেন? আমরা কি জংলি? উদ্ভট কিছু দেখলেই কিনে ফেলতে হয়? কি এক বস্তু নিয়ে এসেছ–কালো, ছাতা পড়ে আছে। তোমার মেয়েরা তো এই জংলি জিনিস এথনো যাবে না।
আমার জন্যে আলাদা করে একটু রান্না করে দিও।
তোমার জন্যে আলাদা রান্না? একবাড়িতে দুরকমের রান্না? ভাবতেও খারাপ লাগল না? একজন উর্দি পরা বাবুর্চি রেখে দাও। যে শুধু তোমার রান্না-বান্না করবে। জংলি আলু কিনলে। জংলি মোরগ কিনবে। বাজারে জংলি মোরগ পাওয়া যায় না?
মেটে আলু বাড়িতে রান্না হয় নি। রান্নাঘরের এক কোনায় কিছুদিন আলুগুলি পড়ে রইল। তারপর সেখানেই চারা গজিদে গেল। সোনালি এবং সবুজ রঙের গাছ প্রতিদিন একটু একটু করে বাড়ছে। দেখার মতো দৃশ্য। রহমান সাহেব প্রতিদিন অফিসে যাবার আগে টুক করে ক্লান্নাঘরে ঢুকে দেখে আসতেন। একসময় তিনি বাড়ির পেছনে চারাগুলি পুঁতে দিলেন। গাছ যদি হয় মন্দ কি? গাছের শুন্যে আলাদা যত্ন করতে হবে না। জংলি গাছ— এদের যত্ন লাগে না। শায়লার নজরে হয়তো পড়বে না। বাড়ির পেছন দিকে সে যায় না।
আরেকবার তিনি এক ডজন কুমড়ার ফুল নিয়ে এলেন। কুমড়ার ফুল সচরাচর পাওয়া যায় না। আর পাওয়া গেলেও নেতিয়ে থাকা ফুল পাওয়া যায়। সেদিনের মুললি ছিল টাটকা। মনে হচ্ছিল কিছুক্ষণ আগেই গাছে থেকে পাড়া হয়েছে। ফুলের বোটায় কষ লেগে আছে। শায়লা ফুল দেখে ভুরু কুঁচকে বললেন, মুল দিয়ে কি করতে হবে? বড় বানিয়ে খাওয়াতে হবে?
রহমান সাহেব নিচু গলায় বললেন, কুমড়া ফুলের বড়া অতি সুখাদ্য। টাটকা। টাটকা ভেজে দিও। তোমার মেয়েরা পছন্দ করবে।
শায়লা বিরক্ত গলায় বললেন, পরে বেসন নেই। কেন এইসব যন্ত্রণা কর? ফুল পাওয়ার দরকার কি? গুল দেখার জিনিস। সেই মুল খেয়ে ফেলতে হবে। কেন? ফুলের বড়া ডুবা তেলে ভাজতে হয়। কি পরিমাণ তেল লাগে সেটা জান। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছি খরচ কমাতে আর তুমি চেষ্টা করছ কিভাবে খরচটা তিনগুণ করা যায়।
রহমান সাহেব বেসন কিনে আনলেন, তেল কিনে আনলেন। এতো আয়োজনের সেই ফুল শেষপর্যন্ত ভাজা হলো না। শায়লা মুল ধুতে গিয়ে দেখেন–ফুলের ভেতর থেকে হলুদ পোকা বের হচ্ছে। তিনি তৎক্ষণাৎ লুকে বললেনহল মেলে দিয়ে আসতে।
রহমান সাহেব আজ আর সব্জি বাজারে গেলেন না। সরাসরি মাছের এলাকায় চলে এলেন। কত রকমের মাছ সাজানো। দেখতেই ভালো লাগে। মেয়েরা যেমন শাড়ি-গয়নার দোকান ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে সুন্দর কোনো শাড়ি দেখলেই বলে এই শাড়িটা নামান তো জমিনটা দেহি। রহমান সাহেবও তাই করেন। নতুন কোনো মাছ দেখলেই খুব আনন্দের সঙ্গে মাছ হাতে নেন। রামসোছ মাছের দাড়িতে হাত বুলাতে তার ভালো লাগে। টাটকা বোয়াল, মুখটা লাল মনে হয় এই মাত্র ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে মুখ হয়ে তাকিয়ে থাকার মতো দৃশ্য। টাটকা বাছা মাছ দেখে মনে হয় রূপার পাত। কেমন ঝকমক করে।
রহমান সাহেব আজ এসেছেন মাছ কিনতে দেখতে না। অনেকদিন থেকেই তার একটা ভালো ইলিশ মাছ কেনার শখ। গোল সাইজের মাঝারি ইলিশ। চোখে ইমৎ লাল রঙের ছোপ। বরিশালের ইলিশ না, পদ্মার ইলিশও না, চাঁদপুরের ইলিশ। পদ্মার ইলিশ খুব সুস্বাদু বলে যে কথাটা প্রচলিত এটা ঠিক না। এখন স্বাদের ইলিশ–চাঁদপুরের ইলিশ।