বলে ফেল। চুপ করে আছিস কেন?
দুঃসংবাদ আস্তে আস্তে দিতে হয় এই জন্যে চুপ করে আছি। যা-ই হোক বলে ফেলি— বড়খালা বিয়ের যে খবরটা দেবেন বলেছেন সেই খবরটা হলো— না। ওরা তোমার বড়মেয়ের ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড না। সোনারগাঁও হোটেল থেকে আনা চার পাউন্ডের কেকের টাকাটা ওদের পানিতে গেছে।
তুই কী করে জানলি?
যেভাবেই হোক জেনেছি। বড়খালা দুপুরেই খবর পেয়েছেন, খবরটা দিতে তার কষ্ট লাগতে বলে এখনো দিচ্ছেন না।
তুই কখন জেনেছিস?
আমিও তখনই জেনেছি।
কিভাবে জেনেছিস?
চিত্রা হাসিমুখে বলল, মা তুমি ভুলে গেছ যে আমার একটা মোবাইল টেলিফোন আছে।
তোকে কে থর দিয়েছে?
কে দিয়েছে এটা মোটেই ইম্পর্টেন্ট না। খবরটা কি সেটা ইম্পর্টেন্ট। মা শোনো, মরা মাছটা এখন কী করবে?
শায়লা তিক্ত গলায় বললেন, মরা মাছু আমি কি করব মানে? মরা মাছ মানুষ। কী করে?
চিত্রা বলল, রান্না করে খায়, এইটুকু জানি। এই মাছ তুমি নিশ্চয়ই রান্না লবে না।
চিত্র তুই ঢং করছিস কেন? তোর ঢংটা তো আমি বুঝতে পারছি না। বরপক্ষের ওরা না করেছে, তার জন্যে তোকে ঢং করতে হবে কেন?
তুমি খুবই মন খারাপ করে আছ তোমার মন খারাপ ভাবটা কমানোর অনন্য করছি।
শায়লা পানির ঝাড়ি হাতে নিয়ে গাছে পানি দিতে গেলেন। তার রীতিমতো কান্না পাচ্ছে। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন এই বিয়েটা হবে। বিয়ের পর মেয়েসামাই হানিমুন করতে চলে যাবে ইউরোপে। মানুষকে এই খবরটা দেয়াতেও তো আনন্দ। দুলী-দুঃখী মুখ করে বলা— মনটা খুব খারাপ। মেয়ে-জামাই হানিমুন করতে ইউরোপ যাচ্ছে। সুইজারল্যান্ডে হানিমুন করবে সেখান থেকে ফ্রান্স আর ইতালি হয়ে দেশে ফিরবে। মেয়েটাকে এতদিন দেখা না ভেবেই কেমন যেন লাগছে। আমি ওদের বললাম, তোরা দেশে হানিমুন কর। দেশে কত সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে সেখানে যা, কক্সবাজার যা, টেকনাফ যা, কুয়াকাটা মা। সমুদ্র ভালো না লাগলে রাঙ্গামাটি যাঁ, জাফলং যা। দুজনের মধ্যে ভালোবাসা থাকলে চাঁদপুরও যা সিঙ্গাপুরও তা। এইসব কিছুই বলা যাবে না। সাধারণ কোনো একটা ছেলের সঙ্গে চিত্রার বিয়ে হবে। যে নতুন বউকে নিয়ে রিকশায় শ্বশুর বাড়িতে আসবে। রিকশা ভাড়া কমানোর জন্যে রিকশাওয়ালার সঙ্গে চেঁচামেচি করবে।
চিত্রা মার দিকে তাকিয়ে বলল, মা শুধু-শুধু গাছে পানি দিচ্ছে। আকাশে কি রকম মেঘ করেছে দেখ। এক্ষুণি বৃষ্টি নামবে।
শায়লা জবাব দিলেন না। চিত্রা বলল, মা আমার একটা অনুরোধ রণিবে? প্লিজ। স্কলারশিপের পনেরোশ টাকা আমার কাছে আছে। চল সবাই মিলে বাইরে খেতে যাই। ফুর্তি করে আমি। তুমি মুখ ভোতা করে আছ দেখতে অসহ্য লাগছে।
আমার মাথা ধরেছে আমি কোথাও যাব না।
চিত্রা বলল, মা শোনে ওরা তিনবার করে আমাকে দেখে গিয়ে জানিয়েছে মেয়ে পছন্দ হয় নি। আমি কি পরিমাণ অপমানিত হয়েছি তুমি বুঝতে পারছ না? তুমি মনখারাপ করে অমাৱ অপমানটা আরো বাড়াচ্ছে। হাতমুখ ধুয়ে একটা ভালো শাড়ি পরে চল যাই হৈচৈ করে আসি।
বললাম তো আমার মাথা ধরেছে। তা ছাড়া চাইনিজ-ফুড আমার ভালোও লাগে না।
যাবে না?
না।
চিত্রা চিন্তিত গলায় বলল, মা আরো একটা দুঃসংবাদ আছে। তোমার মাছদের মধ্যে মড়ক লেগেছে, আরেকটা মাছ মারা গেছে। দাড়িওয়ালা একটা গোল্ডফিশ ছিল না। ঐ টা।
বৃষ্টির ফোটা পড়তে শুরু করেছে। এখনো শায়ালা গাছে পানি দিচ্ছেন। ঘরে টেলিফোন বাজছে শায়লার তাতে কোনো ভাবান্তর হচ্ছে না। অথচ কিছুক্ষণ আগেই টেলিফোনের শব্দ শুনলেই চমকে উঠছিলেন। মীরা বারান্দায় এসে অবাক হয়ে বলল, মা তুমি বৃষ্টির মধ্যে গাছে পানি দিচ্ছে কেন? শায়লা পানির ঝাঝরি নামিয়ে রাখলেন।
মীরা বলল, বড়খালা টেলিফোন করেছেন। তোমাকে চাচ্ছেন।
শায়লা পানির ঝাঝড়ি রেখে উঠে এলেন। একটু সময় পেলে ভালো হতো মেজাজ ঠিক করা যেত। গলার স্বর শুনে বড়আপা মোন বুঝতে না পারে সে ম খারাপ করেছে।
হলো বড়আপা। কেমন আছ?
ভালো আছি তোর গলা এরকম শোনাচ্ছে কেন? অসুখ নাকি রে?
ঠাণ্ডা লেগেছে। একটু জ্বর-জ্বররে আছে।
মেয়ের এত বড় শুভসংবাদ আর তুই কিনা মেদামারা হয়ে আছিস!
শায়লার বুকে ধক করে উঠল। মেয়ের এত বড় শুভসংবাদ মানে কী?
হ্যালো, শালা এদিকে আমার বিপদটা শোন। আমার সমস্যা তো জানিস। কিছু হলেই নফল নামাজ মানত করে ফেলা। আমি পঞ্চাশ রাকাত নফল নামাজ মানত করেছিলাম। হাঁটুর ব্যথা নিয়ে পঞ্চাশ রাকাত নামাজ পড়া সোজা কথা?
শায়লার মাথা ঝিমঝিম করছে। সংবাদ কি শুভ? তাহলে চিত্রা এসব কি বলল?
চিত্রার বড় থালা হড়বড় করে কথা বলছেন। তার মুখ ভর্তি পান। সব কথা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। তিনি বললেন–ছেলেপক্ষ কি বলেছে সব তো ডিটেল ঢিলাকে বলেছি। ওরা দুটার সময় টেলিফোন করেছে। মেয়ে তাদের খুবই পছন্দ। বিয়ের তারিখ করতে চায় সেপ্টেম্বরের সাত। ছেলে বিয়ের পর হানিমুনে যাবে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। চিত্রার পাসপোর্ট আছে কি না, না থাকলে ইমিডিয়েটলি করতে বলল। আগামী বৃহস্পতিবার সন্ধ্যাবেলায় এনগেজমেন্ট করতে চায়। কোনো সমস্যা আছে কি না জানতে চাইল। আমি তার সঙ্গে কথা না-বলেই বলে দিয়েছি সমস্যা নেই। সমস্যা আছে?
না। কিসের সমস্যা।
ওরা দশ-পনেরোত্তন আসবে। মেয়েকে রিং পরিয়ে দেবে ঐ রিং আবার আসছে ইংল্যান্ড থেকে। চিত্রার আঙুলের মাপ চেয়েছে। কাল সকালের মধ্যেই অস্কুলের মাপ লাগবে। তোর মেয়ে রাজকপাণী। এখন আল্লাহ-আলাহ করে ছোটটাকে পার করতে পারলে তুই একেবারে ঝাড়া হাত-পা। শোন শায়লা, আমি কাল সকালে নিজে এসে আঙুলের মাপ নেব। চিত্রাকে বলে রাখবি যেন আমি না-আসা পর্যন্ত লাইরে না যায়। এই কদিন ওর ইউনিভার্সিটি বন্ধ। ও ঘরে বসে থাকবে।