রহমান সাহেব হতাশ গলায় বললেন, মনে পড়ছে না। একটু পরেই মনে পড়বে। ভাই, দুটা মিনিট সবুর কর।
রিকশাওয়ালা রিকশা থামিয়ে ফেলল। তার চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তি। রহমান সাহেব রিকশার সীটে বসে আছেন। বাসার ঠিকানা মনে করতে চাচ্ছেন। যতই মনে করতে চাচ্ছেন ততই সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির সামনের রাস্তায় বড় একটা ডিসপেনসারি আছে। ডিসপেনসারির নাম আরোগ্য। তারপর মনে হল এই ডিসপেনসারিটা তার বাড়ির সামনের রাস্তায় না। অন্য কোথাও। খুব সম্ভব তার অফিসের রাস্তায়। ডিসপেনসারিতে একজন কর্মচারী বসে থাকে। তার গায়ে হলুদ কোট। সে খুবই পান খায়। তার থুতনীতে ছাগলাদাড়ির মতো কিছু দাড়ি। পান খাবার সময় দাড়ি নড়ে। দেখতে মজা লাগে। তিনি অফিসের ঠিকানা মনে করতে চেষ্টা করলেন। সেই ঠিকানা ও মনে পড়ছে না। তার প্রচণ্ড পানির পিপাসা হচ্ছে। তিনি রিকশাওয়ালার দিকে তাকিয়ে করুণ গলায় বললেন, এক গ্লাস পানি খাব।
রিকশাওয়ালা বলল, চাচামিয়া আপনে নামেন। অন্য রিকশায় যান। আমি অখন ভাড়া যামু না।
রহমান সাহেব নেমে পড়লেন। যেদিন থেকে এসেছিলেন সেদিকে হাঁটা নিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের গাড়ির কাছে এসে পড়লেন। গাড়ির ড্রাইভার তাকে দেখে কঠিন গলায় বলল–গিয়েছিলেন কোথায়? চল্লিশ মিনিট ধরে বসে আছি।
রহমান সাহেব অবাক হয়ে দেখলেন ডিসপেনসারিতে হলুদ কোট গায়ে যে কর্মচারীর কথা তিনি ভাবছিলেন আসলে ঘটনা অন্য। এই গাড়ির ড্রাইভারের গায়ে হলুদ কোট। থুতনীতে ছাগলাদাড়ি। আতর মেখেছে বলে ড্রাইভারের গা থেকে কড়া গন্ধ আসছে। এই গন্ধটা আগে পাওয়া যাচ্ছিল না। এখন আতরের গন্ধের জন্যে পাশে দাঁড়ানো যাচ্ছে না।
ড্রাইভার বিরক্ত মুখে বলল, উঠেন গাড়িতে উঠেন।
রহমান সাহেব বললেন, ভাইসাহেব আমার একটা সমস্যা হয়েছে। আমার কিছু মনে আসছে না। কোথায় যাব বুঝতে পারছি না।
ড্রাইভার অবাক হয়ে বলল, এইসব কি বলেন?
রহমান সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, ভাইসাব আমি কি করব আপনি একটু বলে দেন। মনে হয় আমি পাগল হয়ে গেছি। পাগলদের কোনো ঠিকানা মনে থাকে না।
আপনার কোনো ঠিকানা মনে নাই?
জ্বি না।
গাড়িতে যে লাশ, সে আপনার কে হয়?
আমা বোন হয় তার নাম ফরিদা। তার নাম মনে আছে।
বোনের লামা কোথায়?
মনে আসছে না ভাই সাহেব।
ড্রাইভার বলল, আসুন আমার সঙ্গে আপনার মাথায় পানি ঢালি। দুঃখ ধান্ধায় মাথা গরম হয়ে গেছে আর কিছু না। পানি ঢাললে ঠিক হয়ে যাবে। তিন চার লালতি পানি ঢালতে হবে। এই জিনিস আগেও দেখেছি।
রহমান সাহেব বাধ্য ছেলের মতো ড্রাইভারের পেছনে পেছনে একটা চায়ের দোকানে যাচ্ছেন।
চিত্রা এসেছে
শায়লার বুক থেকে পাষাণ ভার নেমে গেছে। চিত্রা এসেছে তিনটায়। এসেই গোসল করে সাজতে শুরু করেছে। চিত্রাকে সাহায্য করছে মীরা। মীরা এখন আনন্দিত। তাকে দেখে মনেই হয় না একটু আগেই সে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছিল। শায়লার নিমন্ত্রিত লোকজন আসা শুরু করেছেন। উত্তরা থেকে শরীর খারাপ নিয়ে এসেছেন চিত্রার খালা। তার একটা আইটেম আনার কথা, তিনি দুটা আইটেম এনেছেন।
পাঁচটার সময় শায়লাকে অবাক করে দিয়ে ফ্ল্যাগ উড়ানো গাড়ি নিয়ে পূর্তমন্ত্রী চলে এলেন। সঙ্গে পুলিশের গাড়ি। তিনি শায়লার দিকে তাকিয়ে বললেন–ভাবী আমি সালু। পূর্তমন্ত্রী। লোকজন অবশ্য বলে ধূর্তমন্ত্রী। হা হা হা। রহমান আমাকে বলল, তার মেয়ের বিয়ে আমি যেন আসি। কাজ কর্ম ফেলে চলে এসেছি। হমান কোথায়?
শায়লা বললেন, ওকে একটা কাজে পাঠিয়েছি। এসে পড়বে। আপনি বসুন।
আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন না ভাবী। আমি আছি। মেয়ের বিয়ে শেষ করে যাব।
শায়ালার অফিসের ডিরেক্টর সাহেব এসেছে। এই লোকের স্ত্রী জার্মান। অতি রূপবতী মহিলা। ভাত্রী ভাতা লালা বলছেন। শায়লা শাস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। বরপক্ষের লোকজনরা দেশকে কনে পক্ষের লোকজনও তুচ্ছ করার মতো না। ভাবতেই ভালো লাগছে।
আয়োজনের কোনো খুঁত নেই। চকচকে দুহাজার টাকার নোট নিজাম সাহেব গুলিস্তান থেকে নিয়ে এসেছেন।
শায়লার বাড়ি লেনিনে গমগম পড়ছে। বরপক্ষের লোকজন আসছে। পূর্তমন্ত্রীর সঙ্গের পুলিশের গাড়ি পুলিশ ট্রাফিক কনট্রোল করছে। আড়াল থেকে এই দৃশ্য দেখে আনন্দে শায়লার চোখে পানি এসে গেল। মীরা এসে তাঁকে বলল, মা কি সর্বনাশ। গেস্টরা সব এসে গেছে, তুমি তো এখনো শাড়ি বদলাও নি। তাড়াতাড়ি বাথরুমে যাও।
আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের গাড়ি
আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের গাড়িটা নেত্রকোনার দিকে যাচ্ছে। রহমান সাহেবের গ্রামের বাড়ির ঠিকানা মনে পড়েছে। বোনকে নিয়ে তিনি গ্রামে রওনা হয়েছেন। ড্রাইভার নিজেই আগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছে। এত দূর যেতে পারব না। বাড়তি টাকা লাগবে। এ জাতীয় কথা একটিও বলে নি।
রহমান সাহেবের কেমন যেন শান্তি শান্তি লাগছে। যেন তিনি মস্তবড় একটা সমস্যার হাত থেকে বেচেছেন। সামনে আর কোনো সমস্যা নেই। তিনি নিচু স্বরে হঠাৎ হঠাৎ ফরিদার সঙ্গে কথাও বলছেন। তার মনে হচ্ছে ফরিদা মারা যাবার পরও তার কথা বুঝতে পারছে। এবং ফরিদা নিজেও টুকটাক দুএকটা কথা বলছে। যেমন ফরিদা বলল, ভাইজান তুমি যে চুড়িগুলি আমার জন্যে কিনেছ সেগুলি পরিয়ে দাও।
তিনি বললেন, মরা মানুষের হাতে চুড়ি পরানো ঠিক না।
ফরিদা বলল, কেউ তো আর দেখছে না। ভাইজান তুমি পরিয়ে দাও। বাম হাতে দাও, ডান হাত থ্যাঁতলে ভেঙে এমন হয়েছে চুড়ি পরাতে পারবে না।