রহমান সাহেব আরেক কাপ চা নিলেন। সিগারেট ধরালেন। তার কাছে মনে হল জহির সত্যি কথাই বলেছে। শরীরের কাঁপুনিটা কমে এসেছে। জহির বলল, ভাইজান তাহলে আপনি এই উপকারটা করুন। ডেডবডি নিয়ে আপনার বাসায় চলে যান। আমি পুলিশের ঝামেলা শেষ করে, আজিমপুর গোরস্থানের সঙ্গে কথাবার্তা বলে চলে আসছি। কোরানে হাফেজ টাফেজ জাতীয় কাউকে পান কিনা দেখেন। কোরান পাঠ করতে থাকুক। টাকা-পয়সা যা লাগে আমি দেব।
রহমান সাহেব বললেন, আচ্ছা।
জহির বলল, আপনি যে শক্ত আছেন এটা দেখে ভালো লাগছে। বিপদের সময় কেউ মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারে না। আপনাকে দেখলাম মাথা ঠাণ্ডা। আপনার ব্যাগে কি?
বাজার।
জহির ব্যাগের ভেতর উঁকি দিয়ে বলল, লাউটা ভালো কিনেছেন। লম্বা লাউ মিষ্টি হয়। গোল লাউ দেখতে ভালো, কিন্তু খেতে ভালো না। লাউ কিনে আপনি জিতেছেন।
লাশের গাড়ির ভেতর রহমান সাহেব বসে আছেন। পাশাপাশি দুটা লম্বা সিট। একটায় তিনি বসেছেন। অন্যটায় ফরিদা শুয়ে আছে। শাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। রহমান সাহেবের কাছে মনে হচ্ছে এ অমিলে যদিদা না। অন্য কেউ। কিশোরী কোনো মেয়ে। শাদা কাপড়ে ঢাকা বলেই কি না— ফরিদাকে খুব ছোট খাট মনে হচ্ছে। রহমান সাহেবের দমবন্ধ লাগছে। পাশের গাড়িটা পুলিশের প্রিজন ভ্যানের মতো। কোনো জানালা নেই। একটা ছোট্ট রেলের টিকিট চরের জানালার মতো জানালা আছে। এই জানালা দিয়ে গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গেই শুধু কথা বলা যায়। বাইরের কিছু দেখা যায় না।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে। ড্রাইভারকে এখনো বলা হয় নি কোথায় যেতে হবে। ড্রাইভার অবিশ্যি একবার জিজ্ঞেস করেছে— কোনদিকে যাব? রহমান সাহেব কিছু বলেন নি। গাড়ি কোথায় যাবে তিনি জানেন কি জায়গাটার নাম এই মুহূর্তে মনে আসছে না। একটু পরেই মনে আসবে।
রাস্তার কোনো গর্তে গাড়ি প্রবল ঝাঁকুনি গেল। ফরিদা সিট থেকে পড়ে যাচ্ছিল, রহমান সাহেব ছুটে এসে তাকে ধুলেন। আর তখনি ফরিদা কথা বলে উঠল। চৌবাচ্চার মাছটা যে রকম ক্ষীণ স্বরে কথা বলেছিল সে কম ক্ষীণ স্বর। কিন্তু স্পষ্ট ও তীক্ষ্ণ।
ভাইজান তুমি এটা নিয়ে করছ?
রহমান সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, কি করেছি?
আমাকে কোন বুদ্ধিতে তুমি তোমার বাসায় নিয়ে যাচ্ছে? আজ তোমার মেয়ের বিয়ে। কত লোকজন আসবে। একটা শুভ কাজ হবে। এর মধ্যে তুমি একটা মরা লাশ নিয়ে উপস্থিত হবে। কি সর্বনাশের কথা।
তাহলে কি করব?
ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বল। তারপর গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা ধর। ড্রাইভারের চোখের আড়াল হওয়ামাত্র একটা বেবিটেক্সি নিয়ে বাসায় চলে যাও।
কি বলছিস তুই?
তোমার যাতে ভালো হয় আমি তাই বলছি।
তারপর তোর কি হবে?
আমার যা হয় হবে। মৃত মানুষের কিছু হয় না। তোমার বাড়িতে আজ উৎসব। তুমি যাও তো।
ড্রাইভার গাড়ির গতি কমিয়ে দুবার হন দিয়ে বিরক্ত গলায় বলল, কোথায় যাব বলেন।
রহমান সাহেব বললেন, ভাই গাড়িটা থামান আমার একটু নামতে হবে। দুমিনিট। পিছনের দরজাটা খুলে দেন।
ব্যাপার কি?
ভাইসাহেব বাথরুমে যাব।
ড্রাইভার গাড়ি থামাল। রহমান সাহেব গাড়ি থেকে নামলেন। বিনীত গলায় বললেন, বেশিক্ষণ লাগবে না। পাঁচ মিনিট। আপনি একটা সিগারেট ধরন। সিগারেট শেষ করতে করতে আমি চলে আসব।
ড্রাইভার সিগারেট ধরাল না। নিজের সিটে ফিরে গম্ভীর মুখে বসে রইল। রহমান সাহেব বড় বড় পা ফেলে উল্টো দিকে হাঁটা ধরলেন। লাশের গাড়ি চোখের আড়াল হওয়া মাত্র প্রায় লাফ দিয়ে একটা রিকশায় উঠে পড়লেন।
শায়লার মাথার যন্ত্রণা শুরু
দুপুর থেকে শায়লার মাথার যন্ত্রণা শুরু হল।
চিত্রা বলে গেছে এগারোটার মধ্যে ফিরবে। এখন বলছে এটা দশ। শায়লা অস্থির হয়ে পড়লেন। চিত্রার অনেক বান্ধবীর টেলিফোন নাম্বারই তিনি জানেন। টেলিফোনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। যোগাযোগ করাটা ঠিক হলে কিনা বুঝতে পারছেন না। চিত্রা ঠিকই ফিরে আসলে, মাঝখান থেকে খবর রটবে বিয়ের দিন মেয়ে পালিয়ে গেছে। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা যাক।
ঝামেলা মলিন শুরু হয়। চারদিক বেকে শুরু হয়। উত্তরার বড় আপা আসেন নি। ইসিজি করার পর ডাক্তার তাকে বলেছে কমপ্লিট রেস্টে থাকতে। টেলিফোনেও যেন কারো সঙ্গে কথা না বলেন। তিনি ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে তার বাড়িতে শুয়ে আছেন। এই সময় পাশে থাকলে শায়লা তার টেনশানটা ভাগাভাগি করতে পারতেন। তাছাড়া একটা আইটেম তার রান্না করে নিয়ে আসার কথা। সেই আইটেম সম্ভবত আসবে না।
মীরা নিজের ঘরে শুয়ে আছে। কান্নাকাটি করছে। কিছুক্ষণ আগেই মীরার সঙ্গে তিনি রাগারাগি করে এসেছেন। বিছানায় পড়ে কান্নাকাটি করার মতো কোনো ঘটনা ঘটে নি। এইসব নাটকের কোনো মানে হয় না। একটা ছেলে অন্যায় করেছে। শাস্তি পেয়েছে। এখানেই শেষ। শাস্তিটা হয়তো সামান্য বেশি হয়েছে। সেই বেশির দায়িত্বও মীরার না। সে শাস্তি দেয় নি। তাহলে বিছানায় শুয়ে বালিসে মুখ গুঁজে ফোঁপানোর মানে কি? তিনি মীরার ঘরে ঢুকে বলেছেন, মীরা কি হয়েছে?
মীরা ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলেছে কিছু হয় নি।
তুই ফুঁপাচ্ছিস কি জন্যে?
মন খারাপ লাগছে না। খুবই মন কারাপ লাগছে। আমার মন যে কি পরিমাণ খারাপ তুমি বুঝতেই পারবে না।
কেন মন খারাপ হয়েছে? প্রেমিক কানে ধরে উঠ-বোস কছে এই জন্যে?
মা তুমি বুঝবে না।
আমি বুঝব না আর তুই সব বুঝে ফেলছিস? খবর্দার ফুঁপাবি না। উঠে আয়।