একটা উপহার দিয়েছ আমি তোমাকে সালাম করব না। তুমি আমাকে কি ভাব?
রহমান সাহেবের স্পষ্ট মনে আছে সালাম করে উঠে দাঁড়িয়ে ফরিদা চোখ মুছতে লাগল। উপহার পাবার আনন্দে তার চোখে পানি এসে গেছে।
রিকশায় উঠে রহমান সাহেবের মনে হল বোনের জন্যে আজ ভালো কোনো উপহার নিতেই হবে। তাঁর সবচে পছন্দ কাচের চুড়ি। দুই বাক্স কাচের চুড়ি কিনে নিয়ে গেলে কেমন হয়? কাচের চুড়ি কোথায় পাওয়া যায় তিনি জানেন না। খুঁজে বের করা যাবে। রতন সঙ্গে থাকলে খুব সুবিধা হত। সে চেনে না এমন জায়গা নেই। কেউ যদি রতনকে বলে— রতন একটা ছমাস বয়েসী হাতির বাচ্চা কিনতে চাই। কোথায় পাওয়া যাবে বল তো। রতন সঙ্গে সঙ্গে বলবে, আসেন আমার সঙ্গে।
দুই লাক্স কাচের চুড়ি কিনে রহমান সাহেব ফরিদাদের ফ্ল্যাটে উপস্থিত হলেন। সেখানে অনেক লোকজন পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। বিরাট হৈচৈ। তিনি অবাক হয়ে শুনলেন–ফ্ল্যাট বাড়ির ছাদ থেকে একটা মেয়ে লাফ দিয়েছে। মেয়েটার নাম ফরিদা। তখনো তিনি বুঝতে পারলেন না— এই ফরিদা তার অচেনা কেউ। ফরিদা তারই বোন। ফরিদার জন্যেই তিনি দুই বাক্স কাচের চুড়ি এনেছেন।
অচেনা এক ভদ্রলোক রহমান সাহেবকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেল। জহিরকে শুকনো মুখে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। তার ঠোঁট চিমসে মেরে গেছে। সে সিগারেট টানছে। আর একটু পর পর পুপু ফেলছে। জহিরের সঙ্গে তার কিছু বন্ধু-বান্ধব। তারাও শুকনো মুখে সিগারেট টানছে। প্রত্যেকের চেহারাই কালাসের মতো। রহমান সাহেবকে দেখে জহির এগিয়ে এল। চিন্তিত মুখে বলল, ভাইজান দেখেছেন কি রকম বিপদে পড়েছি। পুলিশ টাকা খাওয়ার জন্যে নানান ফ্যাকড়া করছে। বলছে এটা নাকি সুইসাইড না, হত্যা। তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ছাদে তুলে পেছন থেকে নাকি ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে।
রহমান সাহেব বললেন, কে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে?
বহির বিরক্ত মুখে বলল, কেউ ফেলে নি। কে আবার মেলবে। আমাকে বিপদে ফেলার জন্যে নিজেই পি দিয়েছে। তা ভাগ্য ভালো যে চিঠিতে আমার সম্পর্কে সত্যি কথাগুলি লিখেছে।
কি লিখেছে?
আমি যে স্বামী হিসেবে কত ভালো এইটা লিখেছে। সে যদি লিখত তার মৃত্যুর জন্যে আমি দায়ী তাহলে আজ আমার খবর ছিল। তবে সমস্যা হয়েছে কি ভাইজান, চিঠিটা এখন আছে পুলিশের কাছে। আমার কাছ থেকে টাকা খাওয়ার জন্যে পুলিশ চিঠি গায়েব করে দিতে পারে। আমি চেষ্টা করছি মূল চিঠিটা, মুল চিঠি না হলে তার একটা ফটোকপি হলেও যোগাড় করতে। ফটোকপি আমি একজন ফার্স্টক্লাস ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে এটাচড করিয়ে নেন।
রহমান সাহেব কি বলবেন ভেবে পেলেন না। তার প্রচণ্ড ভয় লাগছে। বুক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ফরিদা মারা গেছে এই ব্যাপারটা এখনো তার কাছে সে রকম স্পষ্ট হয় নি।
জহির হাতে সিগারেট ফেলে আরেকটা সিগারেট ধরাল। রহমান সাহেবের দিকে ঝুঁকে এসে বলল, গত রাতে আপনি ফরিদাকে রেখে চলে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমি দরজা খুলে তাকে বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে। যা হবার হয়েছে। এখন ঘরে ঢোক। হাত মুখ ধুয়ে ভাত খাও। সে তখন বলল, না। তারপর রাগ দেখিয়ে ফট ফট করে ছাদে চলে গেল। আমার তখনই উচিত ছিল তাকে ছাদে যেতে না দেয়া। সে যে আমাকে এত বড় বিপদে ফেললে আমি চিন্তাও করি নি।
রহমান সাহেব চুপ করে আছেন। তার কেমন যেন লাগছে। মনে হচ্ছে না ঘটছে তার কিছুই সত্যি না। স্বপ্নের ভেতর ঘটেছে। তিনি দুঃস্বপ্ন দেখছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি জেগে উঠবেন। তখন আর এই ঝামেলায় থাকতে হবে না।
জহির বলল, ভাইজান চালাবেন?
রহমান সাহেব বললেন, না। পানি থাব।
ঐ দোকানের দিকে চলেন, পানি খাবেন চাও খাবেন। এরা চা-টা ভালো বানায়। আমি ছয় কাপ চা খেয়ে ফেলেছি। সকালে নাশতা টাশতা কিছুই থাই নি। চায়ের ওপর আছি।
রহমান সাহেব যন্ত্রের মতো জহিরকে অনুসরণ করলেন। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চায়ে চুমুক দিলেন। জহির ভুল বলে নি। চা-টা ভালো। জহির বলল, ভাইজান আপনি এসেছেন খুব ভালো হয়েছে। আপনি আমার একটা উপকার করেন।
কি উপকার?
কিছুক্ষণের মধ্যেই সুরতহাল হয়ে যাবে। টাকা দিয়ে মনে করেছি। উপর থেকে মন্ত্রী লেভেলে চাপও দিয়েছি। ডাবল একশান। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডেডবডি হ্যান্ডওভার করে দেবে। আমি আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের গাড়ি যোগাড় করেছি। আপনি ডেড বডি নিয়ে যান। আমি পুলিশের ঝামেলা শেষ করে আসছি।
রহমান সাহেব অবাক হয়ে বললেন, কোথায় নিয়ে যান?
জহির বিরক্ত মুখে বলল, আপনার বাড়িতে নিয়ে যান। এ ছাড়া তো আর জায়গা দেখি না। আমার ফ্ল্যাটে নেওয়াই যাবে না। রাজ্যের মানুষ ভিড় করে আছে। সাংবাদিক ফাংবাদিকও আছে। এরা ভেবেছে মশলাদার কোনো ঘটনা আছে—ফ্রন্ট পেজ নিউজ করে পত্রিকার সার্কুলেশন বাড়বে। চা আরেক কাপ খাবেন ভাইজান?
না।
খান আরেক কাপ। নার্ভ ঠিক থাকলে। চায়ের মধ্যে কেফিন আছে। কেফিন নার্ভ ঠিক রাখে। এই আমাদের আরো দুকাপ চা দাও। ভাইজান আপনি চায়ের সঙ্গে সিগারেটও খান। চায়ের কেফিন আর সিগারেটের নিকোটিন— দুইটায় মিলে নার্ভ একেবারে পুকুরের পানির মতো ঠাণ্ডা রাখবে। আমি যে এত নর্মাল আছি— এই দুই বন্ধুর জন্যে আছি। সকালে খুবই কান্নাকাটি করেছি। তারপর ভাবলাম আগে কাজ গুছায়ে নেই। তারপর কান্নাকাটি। কান্নাকাটির সময় পার হয় নাই। সারাজীবনই কান্নাকাটির জন্যে পড়ে আছে।