এত উঁচু থেকে নিচে তাকানোর মলে আরো একটা ঘটনা ঘটল–ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে তার ভালো লাগাটা বাড়ল। সে এখন যে কোনো সময় ছাদ থেকে লাফ দিতে পারে। এই জীবনের সমস্ত সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে সমাধান। কারোর যদি বড় ধরনের কোনো অসুখ হয় এবং সেই অসুখের ওষুধ হাতে থাকে তাহলে তৃপ্তির যে ভাবটা হয় ফরিদার তাই হচ্ছে। তার জীবনে অনেক সমস্যা, সেই সমস্যার সমাধান এখন তার হাতে আছে। সমাধান হাতে নিয়ে সে ঘুরছে। বাহ কি আনন্দ! রাত ভোর হওয়া পর্যন্ত সময় আছে। যা করার সে ভোর রাতে করবে। ভোর না হওয়া পর্যন্ত সে ছাদে হাঁটাহাটি করবে।
যদি ছাদ থেকে লাফ দেয়ার সিদ্ধান্তু শেষ পর্যন্ত সে নিয়ে ফেলে তাহলে অবশ্যই কয়েকটা চিঠি লিখে যেতে হবে। চিঠিগুলি পলিথিন মুড়ে সঙ্গে রাখতে হবে। ছাদ থেকে লাফ দেয়ার ফলে শরীর থেতলে রক্ত বের হবে। চিঠিগুলি পলিথিনে মোড়া না থাকলে রক্ত মেখে মাখামাখি হবে। কেউ পড়তেই পারবে না। সে একটা চিঠি লিখবে বাবুকে, একটা লিখবে চিত্রাকে এবং সব শেষ চিঠিটা জহিরকে।
বাবুর চিঠিটা সবচে ছোট। সেখানে লেখা থাকবে–
বাবু টিনটিন
বাবু রিনঝিন
যায়রে
বাবু ফিরে ফিরে চায়রে।
এই ছড়াটা ফরিদার নিজের বানানো। বাবু যখন ছোট ছিল তখন ফরিদা বানিয়েছে। ছোটবেলায় এই ছড়া বলে বাবুর গায়ে কাতুকুতু দিলে সে খুব হাসত। এখন বাবু বড় হয়েছে গম্ভীর ভঙ্গিতে স্কুলে যায়, তারপরেও এই ছড়াটা ফরিদা যখনই বলে বাবু শত গাম্ভীর্যের মধ্যেও ফিক করে হেসে ফেলে। বাবু নিশ্চয়ই তার মার লিখে যাওয়া শেষ ছড়াটা যত্ন করে রেখে দেবে। সে যখন বড় হয়ে চাকরি বাকরি করবে তখন দামি একটা ফ্রেমে ছড়াটা সাজিয়ে দেয়ালে টানিয়ে রাখবে। তার একদিন বিয়ে হবে, বউ আসবে সংসারে। নতুন বৌ আগ্রহ নিয়ে বলবে এটা কি টানিয়ে রেখেছ? ছড়া না? ছড়া বাঁধিয়ে রেখেছ কেন? বাবু গম্ভীর গলায় বলবে— তুমি বুঝবে না। খবর্দার ওখানে হাত দেবে না। মার কথা সে নিশ্চয়ই প্রথম দিনেই নতুন বউকে বলবে না। আমার মা পাঁচতলা বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে গিয়েছিলেন এই কথা নতুন বউয়ের সঙ্গে প্রথম দিনেই আলাপ করা যায় না।
দ্বিতীয় টিঠিটা সে লিখবে চিলাকে। চিত্রা মেয়েটা তার খুব পছন্দের। চিত্রা এই পছন্দের ব্যাপারটা জানে না। পছন্দের ব্যাপার গোপন থাকাই ভালো। সে চিত্রাকে লিখবে–
মা চিত্রা, আজ তোর এনগেজমেন্ট। কি শুভ একটা দিন। এই শুভদিনে অশুভ সংবাদ আসা ঠিক না। কিন্তু মা, কি করব বল— আমার কোনো উপায় ছিল না। এনগেজমেন্ট উপলক্ষে তোর জন্যে একটা শাড়ি কিনেছিলাম। শাড়িটা তোদের বাসায় রেখে এসেছি। কোনো এক সময় পরবি। কেমন মা? তোর বিয়েতে উপহার দেবার জন্যে কানের দুল কিনেছি। সেটা রাখা আছে আমার শোবার ঘরের ড্রেসিং টেবিলের সবচে নিচের ড্রয়ারে। ড্রয়ারে তালা দেয়া। তালা চাবিটা আমার বিছানার তোষকের নিচে। তোষক অল্প একটু তুললে কিন্ত পাবি না। অনেকটা তুলতে হবে। ভেতরে দিকে রেখেছি।
মারে মাছের তেলে মাছ ভাজা বলে যে ব্যাপারটা আছে, তোর উপহার কেনার মধ্যে এই ব্যাপারটা আছে। অনেক আগে তোর মার একটা গয়না আমি চুরি করেছিলাম। এটা বিক্রি করেই তোর শাড়ি, কানের দুল কেনা হয়েছে। তোর একটা মাত্র ফুপু সে আবার মিসেস চুরনি। তোর নিশ্চয়ই খুব খারাপ লাগছে। মারে অভাবে পড়ে আমার এই বিশ্রী অভ্যাস হয়েছে। সোনার দোকানে নিজের গয়না বিক্রি করতে যেতাম। সেখানেই অন্য গয়না দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা সরিয়ে ফেলতাম। অভাব খুব খারাপ জিনিস মা।
তুই তোর বাবার দিকে একটু লক্ষ্য রাখিস। আমার ধারণা আমি না বললেও তুই রাখবি। বিয়ের আগে মেয়েরা লক্ষ্য রাখে তার মার দিকে। বাবার দিকে চোখ পড়ে না। বিয়ের পর সে যখন একজন পুরুষের সঙ্গে বাস করতে যায় তখন তার বাবার কথা মনে পড়ে। চিত্রা মা যতই দিন যাচ্ছে তোর বাবা কেমন যেন আউলা ঝাউলা হয়ে যাচ্ছে। এমনভাবে সে তাকায় যেন তার কিছুই নেই। তুই অবশ্যই মাঝে মাঝে আদর করে তাকে দুএকটা কথা বললি। এটা সেটা রান্না করে খাওয়াবি। এতেই দেখবি মানুষটা কত খুশি হবে। কিছু কিছু মানুষ আছে অল্পতে খুশি হয় কোনো কিছু না পেয়েই খুশি হয়। তোর বাবা সে রকম একজন মানুষ। মানুষটা ডুবে যাচ্ছে। তুই অবশ্য তাকে টেনে তুলবি।
শেষ চিঠিটা লিখতে হবে জহিরকে। এইখানে ফরিদা একটা কায়দা করবে। আমার মৃত্যুর জন্যে তুমি দায়ী এইসব কিছুই লিখবে না। উল্টো ভালো ভালো কথা, মিষ্টি মিষ্টি কথা লিখবে। যাতে চিঠি পড়ে সে একটা ধাক্কার মতো খায়। অন্তত একবার হলেও নিজের মন থেকে বলে–আহারে! মন থেকে কেউ আহারে বললে–সেই আহারে মনের ভেতর ঢুকে যায়। কিছু দিন পর পর সেই আহারে মনের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে–ফিসফিস করে বলে–আহারে। আহারে! আহারে!
জহিরকে সে লিখবে–
তুমি নিশ্চয়ই আমার ওপর খুব রাগ করছ। আমার মাথাটা ঠিক নেই তো এই জন্যে বোকার মতো এই কাজটা করলাম। তোমাকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে এই কষ্টটা আমি নিতে পারছি না। এ জীবনে আমি যে কটি ভালো মানুষ দেখেছি তুমি তাদের মধ্যে একজন। অনেক পূণ্য বলে আমি তোমার মতো স্বামী পেয়েছি। কিন্তু সম্পূর্ণই আমার নিজের দোষে তোমার সঙ্গে থাকতে পারছি না। এই কষ্ট কোথায় রাখি? তুমি ভালো থেকো। শরীরের যত্ন নিও। বাবুকে দেখো। দেখে শুনে দুঃখী দুঃখী টাইপ একটা মেয়েকে বিয়ে করো। যাতে সে বাবুকে ভালোবাসে। যাই কেমন?