রহমান সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, ও থাকতে এসেছে কেন?
সেটা তাকেই জিজ্ঞেস কর। হেন তেন নানান কথা বলছে। তার গায়ে নাকি গরম চা ফেলে দিয়েছে। বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলেছে। কুৎসিত গালাগালি করেছে। মাগী ডেকেছে। সেটা তাদের ব্যাপার। আমি তাতে নাক গলাব না। তুমি তোমার গুণবতী বোনকে তার বাসায় রেখে আস। তা যদি না পার শেরাটন হোটেলে স্যুট ভাড়া করে সেখানে রাখ। আমার এখানে রাখতে পারবে না।
আচ্ছা দেখি।
আহা দেখি না। এক্ষুণি যাও। রিকশা ডেকে নিয়ে এস। তারপর বোনকে নিয়ে রিকশায় উঠ।
আজকের রাতটা থাকুক। কাল সকালে আমি দিয়ে আসল।
অবশ্যই না। যাও রিকশা আন।
রিকশায় উঠতে উঠতে নাদো কাঁদো গলায় বলল, ভাইজান আমরা কোথায় যাচ্ছি?
তোর বাসায় তোকে দিয়ে আসি। জহিরের সঙ্গে মিটমাট করিয়ে দেই। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হয়–আবার ঝগড়া মিটে যায়।
এ বাড়িতে যাওয়া আমার পক্ষে সকালে না ভাইজান।
ঐ বাড়ি ছাড়া যাবি কোথায়?
তোমার কাছে কয়েকদিন থাকতে পারল না?
রহমান সাহেব চুপ করে রইলেন। ফরিদা বলল, ভাইজান তুমি বুঝতে পারছ না। বাবুর বাবা তোমাকে খুবই অপমান করলে। তুমি সোজা সরল মানুষ। তোমাকে অপমান করলে আমার খারাপ লাগবে।
রহমান সাহেব বোনের পিঠে হাত রেখে নরম গলায় বললেন, আত্মীয়স্বজনে মধ্যে আবার মান অপমান কি? রাগের সময় জহির কিছু উল্টা পাল্টা কাজ করেছে। এখন নিশ্চয়ই রাগ পড়ে গেছে। এখন সে লজ্জিত। দেখবি আমি সব ঠিক ঠিক করে দিয়ে আসব। রাতে তাদের সঙ্গে ভাত খাব। দরকার হলে রাতটা তোদের সঙ্গে থাকব।
ভালো সময়ে কত থাকতে বলেছি–তুমি থাক নি। আজ থাকবে।
তুই কাঁদিস না। বেশি কাঁদা হার্টের জন্যে খারাপ। হার্টে প্রেসার পড়ে। আমি পত্রিকায় পড়েছি। তুই বরং এক কাজ কর, মনে মনে ওয়াস্তাগফিরুল্লাহ ওয়াস্তাগফিরুল্লাহ পড়তে থাক। এতে বিপদ কাটা যায়। আমি নিজেও পড়েছি।
ফরিদা বড়ভাই-এ কথা অনুযায়ী মনে মনে ওয়াস্তাগফিরুল্লাহ পড়ছে এবং তার মনে হচ্ছে এতে কাজ দিবে। বাসায় গিয়ে দেখবে জহিরের রাগ পড়ে গেছে। সে ভালো মানুষের মতো বসে আছে। ফরিদাকে দেখে যেন কিছুই হয়নি। এমন ভঙ্গিতে বললে তাড়াতাড়ি খাবার দাও তো ক্ষিধে লেগেছে। বাবু না খেয়ে বুমিয়ে পড়েছে। ওকে ঘুম থেকে তোল।
মুরগির কোরমা রান্না করাই আছে। পোলাও রেঁধে ফেলতে হবে। ভাইজান খাবে বলেছে তার জন্যে ঝাল তরকারি একটা থাকলে ভালো হত। ঘরে বেগুন আছে। বেগুন ভেজে দিলে হয়। বেগুনটা আজ অন্য রকম ভাবে ভাজি করবে। বেগুন কুচি কুচি করে তার সঙ্গে নারকেল। ভাইজান রাতে থাকবে। বিছানার চাদর আছে কিনা কে জানে। মনে হচ্ছে নেই। বিছানার চাদর ফরিদা নিজে ধুতে পারে না। লন্ড্রিতে ধোয়াতে হয়। লন্ড্রিতে পাঠানোর কাপড়ে সে এ জায়গায় করে রেখেছে। পাঠানো হয় নি। এর পর থেকে গেস্টরুমের জন্যে এক সেট চাদর, বালিশের ওয়ার ধুয়ে তুলে রাখতে হবে।
ভাইজান।
কি রে?
মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তোমার কেমন লাগছে?
কোনো রকম লাগছে না।
আমরি অদ্ভুত লাগছে। মেয়েটা বড় হয়েছে আমার কাছে মনেই হয় না। ছেলেবেলায় ও যে দাড়িওয়ালা মানুষ দেখলেই কাঁদত এটা কি তোমার মনে আছে?
না।
কি আশ্চর্য! তোমার মনে থাকার তো কথা। দাড়িওয়ালা কাউকে দেখলেই ও ভয়ে সিঁটিয়ে যেত। চিৎকার করে কান্না। তখন আমি তাকে বলতাম–দেখিস তোর বিয়ে হবে দাড়িওয়ালা বরের সঙ্গে। ভাইজান শুর বরের কি দাড়ি আছে? আমি সাধারণ দাড়ি কুণা বলছি না, ফ্রেঞ্চকাট টাইপ স্টাইলের দড়ি।
জানি না তো।
সে কি তুমি ওর বরকে এখনো দেখ নি?
না।
ওর বরের নাম কি?
জানি না।
সত্যি জান না।
জানতাম এখন ভুলে গেছি।
তুমি তো ভাইজান খুবই আশ্চর্য মানুষ।
হুঁ।
তুমি অবশ্যি আগে থেকেই আশ্চর্য ছিলে— এখন যত দিন যাচ্ছে ততই বেশি আশ্চর্য মানুষ হচ্ছে। তোমাকে যে ওষুধগুলি খেতে দিয়েছিলাম সেগুলি খাচ্ছ?
হুঁ।
তোমার চেহারা ভয়ংকর খারাপ হয়ে গেছে। চেহারার মধ্যে ভিখিরী ভিখিরী কাল এসে গেছে। মাথার সব চুল পাকা। তোমার পাশে ভাবীকে দেখলে মনে হয় ভাবী তোমার মেয়ে। তুমি চুলে কলপ দিও তো।
আচ্ছা।
তুমি মুখে বললে আচ্ছা। কিন্তু আসলে দেবে না। আমি ব্যবস্থা করব। রাতে তুমি তো আমার এখানে থাকবে–আমি দোকান থেকে বাবুর বাবাকে দিয়ে একটা কলপ আনিয়ে সকালে চুলে কলপ দিয়ে দেন।
আচ্ছা।
ফরিদাদের ফ্ল্যাটে বাতি জ্বলছে। লোকজনের কথা শোনা যাচ্ছে। পাহমান সাহে বললেন, তোর বাসায় মনে হয় অনেক লোকজন। ফরিদা ক্ষীণ গলায় বলল, ওর বন্ধুরা এসেছে। তাস খেলছে। ফরিদা কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করছে। বন্ধুদের সামনে জহির নিশ্চই খুব খারাপ ব্যবহার করবে না। তাছাড়া সঙ্গে তার বড়ভাই আছে। বাবুর জন্যেও ফরিদার একটু দুঃশ্চিন্তা হয়। বাবু কি বাসায় আছে? ঘুমিয়ে পড়েছে না-কি জহির বাবুকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছে?
ফরিদা ভয়ে ভয়ে কলিং বেল টিপল। একবার, দুবার তিনবার। চতুর্থবার কলিং বেল টিপতেই জহির বের হয়ে এল। তার পরনে লুঙ্গি। খালি গা। ফরিদার বুক ধক করে উঠল। জহির মদ খেয়েছে। তার চোখ লাল। মদ খেলেই জহিরের চোখ লাল হয়ে যায়। ঠোঁট ফুলে ওঠে। নেশাগ্রস্ত মানুষ কোনো কিছুই ধার ধারে না। সে কি করবে কে জানে। নোংরা গালিগালাজ না করলেই হয়। মদ খেলেই জহিরের মুখ থেকে কুৎসিত সব গালাগালি বের হয়। বস্তির লোকরা যে ভঙ্গিতে বলে–তোর মাকে এই করি। সেও ঠিক তাই বলে। তাদের চেয়েও খারাপ ভালে বলে। ফরিদার হাত-পা কাঁপতে লাগল।