ফরিদা চা আনতে গেল। নতুন টি পটে করে চা এনে জহিরের সামনে রাখল। টি পটটা এত সুন্দর যে দেখবে তারই মন ভালো হয়ে যাবে। টি পটের সঙ্গে দুটা কাপ। দুজন এক সঙ্গে বসে চা খাওয়া। ফরিদা বলল, চায়ের সঙ্গে কি খাবে? চিড়া ভেজে দেব?
জহির বলল, চিড়া পদে ভাণ্ডলে। আগে বল তুমি কি আমার কোটের পকেটে হাত দিয়েছিলে?
কোটের পকেটে হাত দেব কেন?
কোটের পকেটে তিনটা পাঁচশ টাকার নোট ছিল। নোট দুটা নেই।
তোমার কাছ থেকে আমি টাকা চুরি করব?
আগে তো অনেকবারই করেছে। আমার পকেট থেকে টাকা নেয়া তো নতুন কিছু না।
আমি তোমার কোটের পকেটে হাত দেই নি। টাকাও নেই নি।
সত্যি কথা বল।
সত্যি কথাই বলছি।
এই টি পটটা নতুন কিনেছ না?
হুঁ।
কবে কিনেছে?
আজ কিনেছি।
টাকা কোথায় পেয়েছ?
আমাণ না কিছু টাকা ছিল। ভাইজান কয়েকদিন আগে শে এসেছিলেন। ইলিশ মাছ নিয়ে তখন দিয়ে গেছেন।
জহির থমথম গলায় বলল, এখনো সময় আছে সত্যি কথা বল।
সত্যি কথাই তো বলছি।
তোমার ভাই এসে হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে গেল। ফাজলামী করছ। দিনের পর দিন ভাইয়ের কোন খোঁজ নাই, সেই ভাই হয়ে গেল হাজী মোহাম্মদ মহসিন?
ভাইজান সম্পর্কে এইভাবে কথা বলবে না।
তোমার ভাইজান সম্পর্কে কি ভাবে বলা বলতে হবে নিল ডাউন হয়ে?
ফরিদার চোখে পানি এসে গেল। জহির কঠিন গলায় বলল, চোখের পানি মুছ। এক্ষুণি মুছ। আর কাপড় পর।
ফরিদা কাঁদতে কাঁদতে বলল, কাপড় পরব কেন?
জহির কঠিন গলায় বলল, হাতেনাতে চোর ধরব। তোমার ভাইজানকে জিজ্ঞেস করব–ইলিশ মাছের সঙ্গে কত টাকা দিয়েছেন? আজ আমি হেস্ত নেস্ত করব। ধান কুটে বের করে ফেলব কত ধানে কত চাল।
ফরিদা হতাশ বোধ করছে। জহিরের কোটের পকেট থেকে সে কোনো টাকা নেয় নি। কিন্তু অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে মনে হচ্ছে অপরাধ না করেও অপরাধ স্বীকার করে নেয়াটা মঙ্গলজনক হবে। সে আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলল, তোমার কোটের পকেট থেকে আমি টাকা নিয়েছি। এখন কি করবে? আমাকে মারবে? গায়ে গরম চা ঢেলে দেবে?
হির কিছু বলছে না। চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। তার ভাব ভঙ্গি শান্ত। এই শান্ত ভঙ্গিটাকেই ফরিদার ভয়। ভয়ঙ্কর কিছু করার আগে আগে মানুষ শান্ত হয়ে যায়।
জহির কি করতে পারে ফরিদা দ্রুত চিন্তা করছে। চড় থাপড় দিতে পারে। দিলে খারাপ না, বাবু বাসায় নেই সে দেখবে না। ঘরে কোনো কাজের লোক নেই। কেউ জানবে না। (এই জাতীয় দৃশ্য কাজের লোকদের দেখা মানে ভয়ঙ্কর ব্যাপার। প্রতিটি ফ্ল্যাটের লোকজন জেনে যাবে।) গায়ে গরম চা ঢেলে দিতে পারে। আগে একবার দিয়েছে। ভাগ্যিস মুখে পড়ে নি। কানে আর বুকে পড়ে ছিল। ফোসকা পড়ে হয়ে বিশ্রী অবস্থা। ডাক্তারের কাছে গিয়ে ব্লাউজ খুলে বুক দেখাতে হয়েছে। চোখ দিয়ে দেখলেই বুঝা যায় কতটুক পুড়েছে–কিন্তু সেই বদ ডাক্তার আবার নানান ভঙ্গিমায় হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখেছে। ওষুধ দিয়ে বলেছে কাল আবার আসবেন। ড্রেসিং করে দেব। বুকের সেনসেটিভ স্কিন পুড়েছে তো এই জন্যেই চিন্তা। কথা শেষ করে ব্যাটা আবার বুকে হাত দিয়েছে।
জহির যদি আজ গায়ে চা ঢেলে দেয়–তেমন কোনো সমস্যা হবে না। চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। শরীর পুড়ে গেলেও ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না। আগের বারের মলমটা এখনো আছে। ফরিদা যত্ন করে তুলে রেখেছে। একবার চা ফেলে দিয়েছে, অভ্যাস হয়ে গেছে। আবারো ফেলবে।
জহির তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারে। এর আগেও কয়েকবার বের করেছে। বের করে দিলে খুবই খারাপ হবে। ফরিদার ভয়ঙ্কর কষ্ট হবে। বাসা থেকে বের করে দিলেই ফরিদার মনে হয় এই পৃথিবীতে তার কেউ নেই। তার তখন ইচ্ছা করে কোনো চলন্ত ট্রাকের নিচে ঝাঁপ দিয়ে পড়তে। সাহসে কুলায় না। তার সাহস খুব কম।
রহমান সাহেব বাসায় ফিরলেন রাত আটটায়। ঘরে ঢুকতেই শায়লায় সঙ্গে দেখা। শায়লা গম্ভীর মুখে বললেন, পেছনের বারন্দায় এসো তোমার সঙ্গে কথা আছে।
রহমান সাহেবের বুক ধক করে উঠল। খারাপ কিছু কি ঘটেছে? সময় ভালো না। সবার জন্যে দুগ্নসময়। চারদিকে থান্নাপ থাৱাপ মটন ঘটছে। তার বাড়িতে যে ঘটবে এটা বিচিত্র কিছু না। তার কোনো মেয়ের মুখে কি কেউ এসিড মেরেছে? মাইক্রোবাসে করে একদল যুবক এসে উঠিয়ে নিয়ে গেছে চিত্রাকে? রহমা সাহেবের বুক ধকধক করছে। তিনি ক্ষীণ গলায় বললেন, কি হয়েছে?
শায়লা গলা নামিয়ে বললেন, তোমার বোন বিছানা বালিশ নিয়ে চলে এসেছে। এখন থেকে না-কি আমাদের সঙ্গেই থাকবে।
রহমান সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ও আচ্ছা।
শায়লা বললেন, ও আচ্ছা মানে? তুমি এক্ষুণি তাকে তার বাসায় রেখে আসবে। কাল আমার মেয়ের এনগেজমেন্ট এই সময় আমি বাড়িতে কোনো ঝামেলা রাখব না।
ঝামেলা কেন?
অবশ্যই ঝামেলা। তোমার এই বোনকে আমার খুবই অপছন্দ। শুধু আমার না, বাড়ির সবারই। সে সুযোগ পেলেই জিনিসপত্র সরায়। চিত্রার মামা আমেরিকা থেকে চিত্রার জন্যে ফ্লেক্সিবল কলম পাঠিয়েছিল। চিত্রার কত শখের জিনিস। সেই জিনিস সরিয়ে ফেলল। তোমার বোনের বাসায় যখন সেই কলম পাওয়া গেল, সে বলল চিত্রার কলমটা দেখে তার খুবই পছন্দ হয়েছে। সে গুলশান বনানীর মার্কেট ঘুরে ঘুরে অবিকল চিত্রার কলমের মতো একটা কলম কিনেছে।
রহমান সাহেব বললেন, বিদেশী সব জিনিসই এখন দেশে পাওয়া যায়।
শায়লা কঠিন গলায় বললেন, বোনের পক্ষে কোন ওকালতি করবে না। তোমার বোনকে তুমি চেন না। আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। আমার মুক্তা বসানো গলায় হার সে যে নিয়েছে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত।