চাঁদনি চকের একটা গয়নার দোকানে ফরিদার যাতায়াত আছে। দোকানের এমন কর্মচারীকে ফরিদা মামা ডাকে। গয়নার দোকানে কোনো পাতানো মামা থাকলে গয়না বিক্রি করা সহজ হয়। খুব বিপদে পড়লে এই পাতানো মামার কাছ থেকে সে টাকা ধারও নেয়।
পাতানো মামার ধার ফরিদা সময়ের আগেই শোধ দেয়। নিজে গরজেই দেয়। যে কোনো সময় ধার পাওয়া যায় এমন একটা জায়গা থাকা দরকার। পাতানো মামার নাম রবি হোসেন। লোকটাকে ফরিদার তেমন সুবিধার মনে হয় না। লোকটা প্রায়ই বলে–বাসায় এসে বেড়ায় যাও। সারাদিন থাকবে। খাওয়া দাওয়া করবে। খালি বাড়ি কোনো অসুবিধা নাই।
খালি বাড়ি বলেই তো অসুবিধা। লোকটার বউ থাকলে ঐ বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া কোনো সমস্যা ছিল না। তবে এই কথা ফরিদা বলে না, বরং যতবারই রবি হোসেন ফরিদাকে তার বাড়িতে যেতে বলে ততবারই ফরিদা বলে, জ্বি আচ্ছা যাব। হুট করে একদিন উপস্থিত হব। আপনাকে রান্না করে খাওয়াব। আমি খুব ভালো রান্না জানি।
কবে আসলে বল?
আগে থেকে বলে আসলে তো মজা থাকবে না। কোনো এক ছুটির দিন চলে আসব। মামা আপনার বাসায় ঝুনা নারিকেল আছে? ঝুনা নারিকেল কিনে রাখবেন।
ঝুনা নারিকেল দিয়ে কি হবে?
ঝুনা নারিকেল দিয়ে আমি একটা রান্না জানি খুবই সুস্বাদু। একবার গেলে সারাজীবন ভুলবেন না। কি করতে হয় আমি বলি–প্রথমে নারিকেলটা ফুটা করে পানি ফেলে দেবেন। তারপর মশলা মাথা ছোট ছোট চিংড়ি মাছ এই ফুটা দিয়ে ঢুকিয়ে ময়দা দিয়ে ফুটা বন্ধ করে দেবেন। এখন কয়লার আগুনে নারিকেলটা রেখে তার বাইরেরটা পুড়াবেন। পনেরো বিশ মিনিট আগুনে ঝলসানোর পর নারিকেল ভেঙে চিংড়ি মাছ বের করে গরম ভাত দিয়ে খাবেন। মনে হবে বেহেশতি কোনো খাবার খাচ্ছেন।
ঠিক আছে ঝুনা নারিকেল যোগাড় করে রাখব। তুমি কবে যাবে বল?
যে কোনো একদিন চলে যান। আপনি ম্যাপ এঁকে বাড়ির ঠিকানা ভালো করে একটা কাগজে লিখে দিন। আমি খুঁজে খুঁজে বের করে ফেলব।
ঝামেলা করে বাসায় গিয়ে দেখলে আমি নেই। তখন কি হবে?
আরেক দিন খাব।
রবি হোসেন ঠিকানা লিখে কাগজ দিয়েছে। সেই কাগজ ফরিদা তার হ্যান্ডব্যাগে নিয়ে দিয়েছে। সে কখনো বিপত্নীক একটা মানুষের খালি বাড়িতে উপস্থিত হবে না। এই কথাটা তাকে জানানোর দরকার কি। সে আশায় আশায় থাকুক। বিপত্নীক মানুষ যখন তার খালি বাড়িতে কোনো মেয়েকে ডাকে তার পেছনে একটাই উদ্দেশ্য থাকে। এই উদ্দেশ্য বুঝতে পারবে না ফরিদা এত বোকা না। তবে লোকটার সঙ্গে সে বোকার ভান করে। মতলববাজ পুরুষ বোকা মেয়ে পছন্দ করে।
রবি হোসেন ফরিদাকে দেখে গম্ভীর গলায় বলল, খবর কি?
ফরিদা বলল, খবর ভালো। একটা গয়না বিক্রি করব। আমার শখের গয়না। দূর সম্পর্কের এক খালা বিয়েতে দিয়েছিলেন।
শখের গয়না বিক্রি করবে কেন?
টাকা দরকার। একটা গয়না বিক্রি করে আরেকটা কিনতে হবে।
রনি হোসেন বিরক্ত গলায় বলল, গয়না কেনা আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। মালিকের হুকুম।
ফরিদা বলল, আমাকে বিক্রি করতেই হবে। মামা আপনি ব্যবস্থা করে দিন। আচ্ছা ভালো কথা, আগামী শুক্রবারে কি আপনি বাসায় থাকবেন।
কেন?
বাসায় থাকলে যাব। শুক্রবারে আমার কোনো কাজ নেই। বাবুকে নিয়ে তার বাবা যাবে তার এক দূর সম্পর্কের খালার বাসায়। সারাদিন থাকবে। সারাদিন আমি একা ঘরে বসে থেকে কি করব? ঝুনা নারিকেল যোগাড় করে রাখবেন। লুনা নারিকেল আর কয়লা।
সত্যি যানে?
ও আল্লা সত্যি না তো কি?
ফরিদা যা ভেবেছিল তাই হল। রবি হোসেনের মুখ থেকে গম্ভীর ভাব চলে গিয়ে খুশি খুশি ভাব চলে এল। শুক্রবারের কথা ভেবে এখনই লোকটার চোখ চকচক করা শুরু করেছে। কি হারামজাদা মানুষ।
গয়না বিক্রি করে ফরিদা এক জোড়া কানের টব কিনল। নগদ দুহাজার টাকা পেল। বাড়তি যা পেল সেটাও খারাপ না। কানের টব বাছাই করার ফাঁকে ফরিদা একজোড়া ঝুমকা দুল সরিয়ে ফেলল। সিগারেট খোর লোকরা যেমন পকেটে প্রতিটি সিগারেটের হিসাব রাখে গায়নার দোকানের কর্মচারীও ডিসপ্লে টেবিলের উপর লাগা প্রতিটি গয়নার হিসাব রাখে। রনি হোসেন খুব সম্ভব শুক্রবারের চিন্তায় হিসাব রাখতে পারল না। ফরিদা বলতে গেলে তার চোখের সামনে থেকে কানের টব সরিয়ে ফেলল, লোকটা বুঝতেই পারল না।
দু হাজার টাকা ফরিদা অতি দ্রুত খরচ করে ফেলল। এনগেজমেন্টের দিন চিত্রাকে উপহার দেবার জন্যে সাতশ টাকা দিয়ে হালকা গোলাপি রঙের একটা শাড়ি কিনল। একটা টি সেট কিনল। জহিরের জন্যে দুটা স্ট্রাইপ দেয়া সার্ট কিনল। বাবুর জন্যে ফুটবল। বাবু কয়েকদিন ধরেই পোলাও খেতে চাচ্ছিল। ফরিদা কাঁচাবাজার থেকে পোলাও-এর চাল, মুরগি, কিনল। তারপরও তার হাতে দেড়শ টাকা রইল। এই টাকাটাও সে খরচ করে ফেলত নিল বাবুর স্কুল ছুটি হয়ে যাবে। তাকে আনতে যেতে হবে।
বিকেল পর্যন্ত ফরিদার সময় খুব ভালো কাটল। সকালবেলা জোড়া শালিক দেখায় তেমন কিছু হল না। ফরিদার মনে হল আজকের দিনটা সে ভালো ভাবেই পার করে দিতে পারবে।
জহির অফিস থেকে ফিরল পাঁচটায়। তার মুখ অত্যন্ত গম্ভীর। ভুরু কুঁচকে আছে। দেখেই মনে হচ্ছে সে রাগ চেপে আছে। বেশিক্ষণ রাগ চেপে রাখলে চোখ লালচে হয়ে থাকে। জহিরের চোখ লাল।
ফরিদা বলল, তোমার কি শরীর খারাপ করেছে?
জহির বলল, না।
চোখ মুখ শক্ত করে আছি। অফিসে কিছু ঘটেছে?
জহির বলল, না।