বুঝলি মায়েরা, আমি তখন ছোট। কত আর বয়স ছয় সাত। তখন আমাদের বাড়িতে পেত্নীর উপদ্রপ হল। একটা খারাপ স্বভাবের পেত্নী খুব যন্ত্রণা শুরু করল…
ফরিদার ধারণা সে উল্টা মানুষ
ফরিদার ধারণা সে আর দশজন মানুষের মতো না। সে উল্টা মানুষ। অন্যদের বেলায় যা হয় তার বেলায় উল্টোটা হয়। সবাই জানে দুই শালিক দেখা শুভ। শুধু তার বেলায় দুই শালিক দেখা ভংকর অত। দুই শালিক দেখা মানেই তার ভয়ংকর কিছু ঘটবে।
আজ সকালে বারান্দায় রেলিং-এ ফরিদা দুটা শালিক বসে থাকতে দেখল। তার মনটাই গেল খারাপ হয়ে। বিরাট কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত হয়ে গেল। ফরিদা হুস হুস শব্দ করে শালিক দুটা উড়িয়ে দিতে গেল। শালিকরা নড়ল না। বসেই রইল। ফরিদা জানে শালিক দুটা বসে থাকবে। তার বেলায় উল্টোটা তো হবেই। সে যদি গলায় করে কিন্তু ভাত এনে দিত তাহলে শালিক উড়ে যেত। কারণ সে উল্টো মানবী। দুষ্ট শালিক দুটাকে যত্ন করে ভাত খাওয়াতে ইচ্ছা করছে না। হারামজাদা পাখি থাকুক বসে।
ফরিদার মনে হল সকাল বেলাতেই পাখি দুটাকে দেখা তার জন্যে এক দিকে ভালো হয়েছে। আগে ভাগেই সাবধান হবার সুযোগ পাওয়া গেছে। বাবুকে আজ স্কুলে পাঠানো হবে না। স্কুলে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সে নিজেও বাইরে বের হলে না। যদিও নিউমার্কেটে তার কিছু জরুরি কেনাকাটা ছিল। কেতলীর হ্যান্ডেল ভেঙে গেছে। একটা কেতলী কিনতে হবে। দুটা চায়ের কাপ কিনতে হবে। ঘরে সাতটা চায়ের কাপ আছে। এর মধ্যে দুটা কাপে বোটা ভাঙা। ভালো চারটা কাপ চার রকমের। এই চারটার মধ্যে দুটার আবার পিরিচ নেই। তবে যেহেতু জোড়া শালিক দেখেছে–নিউমার্কেটের কেনাকাটা বন্ধ। জহিরের সঙ্গেও আজ খুব ভালো ব্যবহার করতে হবে। এমন কিছুই করা যাবে না যেন ঝগড়া বেধে যায়। জহির অন্যায় কিছু করলেও চুপ করে থাকতে হবে।
আল্লাহর কাছে ফরিদা মানতও করে ফেলল, আজকের দিনটা যদি ভালায় ভালোয় পার হয় তাহলে এশার নামাজের পর দুই রাকাত নফল নামাজ পড়বে।
জহির ঘুম থেকে উঠল সকাল নটায়। খবরের কাগজ হাতে বারান্দায় এসে বসতে বসতে বলল, চা দাও তো। ফরিদা খুশি খুশি। গলায় বলল, কফি খাবে?
জহির রাগী গলায় বলল, কফি এল কোত্থেকে?
ফরিদা বলল, এক কৌটা কিনেছি। তুমি কি পছন্দ কর।
আমি আবার কবে থেকে কফি পছন্দ করলাম? টাকা-পয়সার এ রকম টানাটানি এর মধ্যে তুমি কফি কিনে ফেললে? সংসার উচ্ছন্নে যাচ্ছে তোমার জন্যে এটা জান? কফির কৌটার মুখ কি খোলা হয়েছে?
না।
তাহলে কি তি দিয়ে টাকা নিয়ে আসলে।
আচ্ছা।
আচ্ছা ফাচ্চা না। আজই যাবে।
ফরিদা চুপ করে রইল। কফির কৌটা ফেরত দিয়ে টাকা আনা যাবে না। কিছু সমস্যা আছে। কফির কৌটাটা সে দোকান থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছে। কাজটা সে করেছে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। তার কাঁধে ছিল একটা বাহারি চটের ব্যাগ। সেই ব্যাগে সে কফি কৌটাটা প্রথম ঢুকাল। তারপর নিল একটা টমেটোর সস। সবশেষে দুটা কাপড় ধোয়া সাবান। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলি বেশ বড় বড়। এমনভাবে জিনিসপত্র সাজানো যে এদিক ওদিক তাকিয়ে যে কোনো কিছু উঠিয়ে নেয়া যায়।
ফরিদা চায়ের কাপ জহিরের সামনে রাখতে গিয়ে বলল, বৃহস্পতিবারটা ফ্রি রাখবে।
জহির চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, বৃহস্পতিবারে কি?
চিত্রার এনগেজমেন্ট।
চিত্রা আবার কে?
ফরিদা অবাক হয়ে বলল, চিত্রাকে তুমি জান না? বড় ভাইজানের মেয়ে।
জহির বলল, যারা আমাকে চিনে না আমিও তাদের চিনি না। গরিব থাকবে গরিবের মতো। বড়লোক থাকবে বড়লোকের মতো। আগবাড়ায়ে খাতির জমানোর কোনো দরকার নাই।
ভাইয়ের মেরে এনগেজমেন্টে আমি থাকব না?
না।
তুমি এইসব কি বলছ?
এটা আমার ফাইন্যাল কলা। যারা তোমাকে ভাবে ভাবে সেই বাড়িতে তুমি যাবে?
তারা আমাকে কখন চোর ভাবল?
এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেছ?
ফরিদা আহত গলায় বলল, কি উল্টাপাল্টা কথা বলছ? আমাকে চোর ভাববে কেন?
দুই বছর আগে তুমি তোমার ভাইয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলে। এক রাত থেকে নিজের ফ্ল্যাটে ফেরার পর কি হয়েছিল?
আমি তো জানি না কি হয়েছিল।
সকালবেলা তোমার ভাবি আমাদের বাসায় চলে এলেন। তার একটা গলার হার খুঁজে পাচ্ছেন না। তুমি ভুল করে তোমার হ্যান্ডব্যাগে নিয়ে এসেছ কি-না জানতে এসেছিলেন। তিনি নিজেই তোমার হ্যান্ডব্যাগ উল্টে-পাটে দেখলেন। তোমার মনে নাই?
ফরিদা সহজ ভঙ্গিতে বলল, এটা ভাবী একটা ভুল করেছে। মানুষ মাত্রই ভুল করে। পরে যখন গয়নাটা পাওয়া গেল ভাবী খুবই লজ্জার মতো পড়ল। আমার কাছে এসে কেঁদে ফেলল।
গয়না পাওয়া গিয়েছিল না-কি?
দুই দিন পরই পাওয়া গেছে। কে যেন তোষকের নিচে রেখে দিয়েছিল।
গয়না পাওয়ার কথা তো আমাকে বল নি।
এটা বলার মতো কিছু না-কি? আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যখন ভাইজানের বাড়িতে যেতে নিষেধ করছ তখন যাব না। তাছাড়া খালি হাতে তো যাওয়াও যায় না। একটা কিছু তো নিয়ে যাওয়া দরকার।
দুই শালিক দেখার পর ফরিদা যে সব প্রতিজ্ঞা করেছিল তার কিছুই মনে রইল না। ফরিদা বাবুকে স্কুলে দিয়ে এসে গয়নার দোকানে চলে গেল। বড় ভাবীর গয়নাটা সে ঠিকই নিয়ে এসেছিল। ঘরে এনে এমন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিল যে কিছুদিন পর সে নিজেই ভুলে গিয়েছিল। জহিরের কথায় মনে পড়ল। গয়নাটা বিক্রি করা দরকার। চিত্রার এনগেজমেন্ট উপলক্ষে সে চিত্রার জন্যে একটা শাড়ি কিনবে। আর বিয়েতে দেবার জন্যে ছয়-সাত আনা সোনায় কোনো কানের দুল। সেপ্টেম্বরের ছ তারিখে চিত্রার বিয়ে তখন হাতে টাকা থাকবে কি থাকবে না, তার নেই ঠিক।