আমি ফিসফিস করে বললাম, ভালো।
দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বোস।
আমি আপার সামনের চেয়ারে বসলাম। আপা আরো আল্লাদী করে বললেন, পড়াশোনা কেমন হয় রে?
আমি বললাম, ভালো।
কোন সমস্যা হলে আমাকে বলবি।
আমি বললাম, জ্বি আচ্ছা।
তোর জন্যে চকলেট আনিয়ে লেগেছি। নে খা। চকলেট খেয়ে কি কুলি করে দাঁত পরিষ্কার করতে হয়। নয়তো দাঁতে মিষ্টি লেগে থাকবে। সেখান থেকে ক্যারিজ হবে। ক্যারিজ কি জানিস তো? দাঁতের পোকা।
ভয়ে ভয়ে চকলেট হাতে নিলাম। তখন আপা তুললেন, তোর এক চাচা যে পূর্তমন্ত্রী সালেহ সাহেব সেই কথা তো তুই কখনো বলিস নি।
আমি চুপ করে আছি। আমার কোনো চাচা পূর্তমন্ত্রী না। কিন্তু আপাকে সেই কথা বলার সাহস নেই। আপা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। কপালে চুমু দিয়ে বললেন, যা ক্লাসে যা। তোকে দেখেই মনে হচ্ছে তুই খুব লক্ষ্মী মেয়ে।
আমি ক্লাসে চলে এলাম। এরপর স্কুলে আমার খুব খাতির হলো। সব আপারা আমাকে চেনে। সবাই আদর করে। পড়া না পারলেও কেউ কোনো দিন বকা দেয় নি। আমিও কখনো তাদের ভুল ভাঙাই নি। দেখলে বাবা কি অদ্ভুত ব্যাপার। আমি ক্লাসের কোনো বান্ধবীকে এখনো বলি নি যে পুরো ঘটনা মিথ্যা। সালেহ সাহেব বলে কোনো পূর্তমন্ত্রী আমার চাচা হওয়া দুরে থাকুক আমি চিনিও না। পূর্তমন্ত্রী যে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যাপার তাও জানি না।
রহমান সাহেব বললেন, সালুকে তুই চিনলি না কেন? আমার সঙ্গে স্কুলে পড়ত। বখাটে টাইপ ছিল। মন্ত্রী হবার আগে কয়েকবার এসেছে। তোকে তো খুবই আদর করত। মন্ত্রী হবার পরেও অফিসে টেলিফোন করে তোর খোঁজ করেছে। কোন ক্লাসে পড়িস এইসব জানেতে চেয়েছে। আমাকে বলেছিল হঠাৎ একদিন পুলিশ টুলিশ নিয়ে তোদের স্কুলে উপস্থিত হবে। তোকে চমকে দেবে।
মীরা অবাক হয়ে বলল, কই আমাকে তো কিছু বল নি।
বলার কি আছে?
আপার বিয়ের এনগেজমেন্টে তাঁকে দাওয়াত করেছ?
না।
কর নি কেন?
তোর মা বলেছে শুধু অফিসের দু-একজনকে বলতে। আমি একজনকে বলেছি।
বাবা তুমি অবশ্যই পূর্তমীকে বলবে। আমাদের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ দুএকজন তো থাকা দরকার। মা কি জানে পূর্তমন্ত্রীকে তুমি চেন?
না তাকে কিছু বলি নি।
অফিসের কাকে নিমন্ত্রণ করেছ? তোমাদের বড় সাহেবকে?
না। রতনকে বলেছি। অত্যন্ত ভালো মানুষ। আমার পিওন।
মীরা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। তার হাসি পাচ্ছে, কিন্তু সে হাসতে পারছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে বাবার কোনো একটা সমস্যা হচ্ছে। বাবা ঠিক স্বাভাবিক না। তাঁর তাকানো, বসে থাকা, কথাবার্তা বলা সব কিছুর মধ্যে সামান্য হলেও অস্বাভাবিকতা আছে। মীরা বলল, রাত অনেক হয়েছে বাবা চল ঘুমুতে যাই।
রহমান সাহেন অবাক হয়ে বললেন, তুই না বললি তুই একটা গল্প বলবি। তারপর আমি একটা বল। আমারটা তো বললাম না।
মীরা বলল, বেশ তো বল।
মাছের একটা ব্যাপার, বুঝলি।
মাছের ব্যাপার মানে-কি?
রাতের বেলায় চেষ্টার কাছে বসেছিলাম। তোর মা তো রাতের বেলা মাছ ঘরে নিয়ে যায়। সেই রাতে নেয় নি। হয়তো নিতে ভুলে গেছে। কিংবা মনে করেছে রোজ রাতে মাছদের নাড়াচাড়া করা ঠিক না। কিছু একটা সে ভেবেছে। মাছগুলি নেয় নি। আমি ওদের পাশে বসে সিগারেট খাচ্ছি, হঠাৎ চৌবাচ্চার ভিতরে মাছ একটা ঘাই দিল। আমি তাকালাম। তারপর দেখি একটা মাছ উপরে উঠে এসে আমাকে বলল–আজ আমাদের খাবার দেয়া হয় নি। মাছদের মতোই বিজবিজ করে বলল, তবে আমি স্পষ্ট শুনলাম এবং বুঝতে পারলাম। এই হলো আমার গল্প।
মীরা অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। রহমান সাহেব নির্বিকার ভঙ্গিতে সিগারেট নিয়েছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে ঘটনাটা বলে ফেলতে পেরে তিনি স্বস্তি পাচ্ছেন।
বাবা মাছ তোমার সঙ্গে কথা বলল?
হুঁ। তোর মাকে আবার বলিস না। তোর মা শুনলে ভেবে বসবে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। দুঃশ্চিন্তা করবে। মেয়েরা আবার দুশ্চিন্তা করতে খুবই পছন্দ করে। দুঃশ্চিন্তা করার কোনো বিষয়ই না, এমন সব নিয়েও তারা দুঃশ্চিন্তা করে। আমার নিজের মাকে দেখেছি তো বেচারী মারাই গেছেন দুঃশ্চিন্তা করতে করতে।
তোমার মা খুব দুঃশ্চিন্তা করতেন?
অতিরিক্ত করতেন। দুঃশ্চিন্তার কারণে তিনি স্থির হয়ে এক জায়গায় বসেও পাকতে পারতেন না। ছটফট করতেন। মনে কর আমি বাথরুমে গেছি। বাথরুম থেকে বের হতে দেরি হচ্ছে। মা ভাববে আমি অজ্ঞান হয়ে বাথরুমে পড়ে আছি। তখন ছুটে এসে বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে বললে—ও রহমান তোর শরীর ঠিক আছে? একটু কথা বল বাবা।
ঘুমুতে এসো বাবা।
তুই যা আমি বসি আরো কিছুক্ষণ। আমার ঘুম পায় নাই। রাত তিনটার আগে আমার ঘুম পায় না। বিছানায় শুয়ে জেগে থাকার চেয়ে এখানে বসে জেগে থাকা ভালো।
মীরা চিন্তিত মুণে ঘরে ঢুকল।
রহমান সাহেবের মনে হলো গান বলতে গিয়ে তিনি ভুল করেছেন। শৈশবের গল্প বলার কথা, তিনি সেটা না করে এই বয়সের একটা কথা বলেছেন। মোটামুটি চুক্তি ভঙ্গ করা হয়েছে। শৈশবে তার অনেক গল্প আছে। ইঁদারার গল্পটা বললে মীরা মজা পেত। গল্পটা সামান্য ভয়ের। তবে মীরার বয়সের ছেলেমেয়েরা ভয়ের গল্প শুনলে মজা পায়। মেয়েটাকে কোনো একদিন সময় করে গল্পটা বলতে হবে। সবচে ভালো হত যদি রোজ রাতে একটা করে গল্প বলতে পারতেন। রাতের খাওয়া দাওয়ার পর তিনি চৌবাচ্চার পাশে এসে বসলেন, কিছুক্ষণ পর মেয়েরা এসে পাশে বসল। তিনি গত শুরু করলেন।