শায়লা বললেন, আয় খেতে আয়। মীরার চোখে ভয়ের ছায়া। ইতি প্রসঙ্গ তার এখন মনে পড়েছে।
টেলিফোনে কার সঙ্গে কথা হয়?
মীরা চুপ করে রইল। শায়লা বললেন, ভাত খেয়ে তুই আমার ঘরে আসবি। কি ঘটনা আমাকে বলবি। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বলবি। ছেলের নাম, কোথায় প্রথম দেখা সব।
মীরা ক্ষীণ স্বরে বলল, শুধু টেলিফোনে কথা হয় মা। আর কিছু না।
দেখা হয় নি এখনো?
না।
না দেখেই প্রেমের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিস? প্রেম এত সস্তা? টেলিফোনে গলার স্বর শুনে প্রেম?
প্রেম না মা।
প্রেম না তো কি?
কথা বলতে ভালো লাগে। তাই কথা বলি।
রোজ কথা হয়?
হ্যাঁ।
ছেলের টেলিফোন নাম্বার কি?
টেলিফোন নাম্বার আমি জানি না মা, আমি টেলিফোন করি না সে করে।
টেলিফোনে অশ্লীল কথা বলে?
না তো। অশ্লীল কথা বললে কেন?
বলবে কি-না সেটা তো আমি জানি না। বলে কি না সেটা বল।
না বলে না।
তুই কখনো ছেলেকে দেখতে চাস এমন কথা বলিস নি? বলিস নি যে আমি নিউ মার্কেটে যাচ্ছি অমুক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকব। শাড়ি পরে যাব–শাড়ির কালার এই— এমন কথা বলিস নি। ঠিক মতো জবাব দে।
বলেছি।
সে দেখা করতে রাজি হয় নি?
না।
টেলিফোনটা আসে কখন? আমি যখন বাড়িতে থাকি না তখন?
হ্যাঁ।
যে ছেলে তোকে টেলিফোন করছে সে খুব ভালো করে জানে আমি কখন বাড়িতে থাকি, কখন থাকি না। তোর সঙ্গে দেখা করছে না ভয়ে। দেখা হলে তোর প্রেম চলে যাবে এই ভয়। আমার ধারণা মজনু–হারামজাদাটা এই কাজ করছে। তুই তো বোকার হদ্দ, বুঝতে না পেরে প্রেমে গড়াগড়ি খাচ্ছিস। ছেলেটা কে তোকে বলে দিলাম। এখন কায়দা করে বের কর। তারপর দেখ আমি ঐ ছোঁড়াকে কি করি। প্রথমে মা ডেকে তোর পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লে তারপর অন্য কথা। কত বড় সাহস। নাম মজনু টেলিফোনে লাইলী যোগাড় করে ফেলেছে। আয় ভাত খেতে আয়।
মীরা বাধ্য মেয়ের মতো ভাত খেতে গেল। মাকে খুশি করার জন্যে তার অতি অপছন্দের টেংরা মাছ ঢার পাঁচটা খেয়ে ফেলল। মীরা ভেবে ছিল খাওয়ার পর মা দ্বিতীয় অধিবেশন বসাবেন। কবে প্রথম কথা হয়েছিল। কি কি কথা সব জানতে চাইবেন। তা হলো না। শায়লার মাথা ধরেছে। তিনি রাতে খেলেন না। এক কাপ দুধ খেয়ে ঘুমুতে গেলেন। তিনি বিছানায় হয়ে থাকবেন ঠিকই তবে অনেক রাত পর্যন্ত তার ঘুম আসবে না। বিছানায় কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করে আবারো উঠে পড়লেন।
মীরা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে বসে রইল। মার কথা তার কাছে সত্যি বলে মনে হচ্ছে। কারণ এই ছেলে টেলিফোনে একবার বলেছিল–মীরা তুমি আজ শাড়ি পরেছ কেন? শাড়িতে তোমাকে অনেক বড় বড় লাগছে।
মীরা অবাক হয়ে বলেছে— আরে সত্যি তো। আমি আসলেই শাড়ি পরেছি। তুমি জান কি ভাবে?
ম্যাজিকের মাধ্যমে জানলাম।
বল তো শাড়ির রঙ কি। তাহলে বুঝব তুমি ম্যাজিক জান।
রঙ হচ্ছে আকাশি।
হয় নি। রঙ মেরুন সবুজ পড়ি।
মীরা বাতি নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। তার ঘুম আসছে না। চাকর টাইপ একটা লোকের সঙ্গে সে দিনের পর দিন তুমি তুমি করে কথা বলেছে। নানান রকম আহ্লাদী করেছে। মজনু ভাইয়ের সঙ্গে গতকালই দেখা হলো। মীরা স্কুলে যাবার জন্যে রিকশা খুঁজছে— মজুন ভাই বাজার করে ফিরছেন। হাত ভর্তি বাজার। একটা চটের ব্যাগ— এমন ভারি যে তাকে নুয়ে পড়তে হচ্ছে। মীরা তাকে দেখেই বলল, মজনু ভাই একটা রিকশা ডেকে দিন তো। মজনু ভাই সঙ্গে সঙ্গে রিকশার খোঁজে গেল। বাজারটা রেখে যেতে পারত। তা করল না, বাজার হাতে করেই গেল। রিকশা নিয়ে ফিরে এসে বলল, মীরা রিকশা ভাড়া দিও না।
মীরা বলল, ভাড়া দেন না কেন?
রিকশা ভাড়া আমি দিয়ে দিয়েছি।
আপনি কেন দেবেন?
ভাংতি ছিল দিয়ে দিয়েছি।
মন ভাই বাজারের ব্যাগ নামিয়ে কপালের ঘাম মুছে আনন্দে হাসতে লাগলেন। যেন বিরাট একটা কাজ করেছে। রাজকন্যা স্কুলে যাবে তার জন্যে এরোপ্লেন কিনে নিয়ে এসেছেন।
মীরার প্রচণ্ড রাগ লাগছে। রাগটা কিছুতেই কমছে না। রাগ নিয়ে ঘুমুতে যাওয়া ঠিক না। ঘুম ভালো হয় না। ঘুমের মধ্যে বোবায় ধরে। স্বপ্নে মধ্যে মনে হয় বিকট কোনো জন্তু বুকের ওপর চেপে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছে। জন্তুটার গায়ে বোটকা গন্ধ। জন্তুটা যে স্থির হয়ে বসে থাকে তাও না। নড়াচড়া করে। মাঝে মাঝে কপালে হাত দেয়। সেই হাত শরফের মতো শীতল এবং শিশুর হাতের মতো ছোট।
বোবার হাত থেকে বাঁচার জন্যে এক বিছানায় শোয়া যাবে না। অন্য কাউকে নিয়ে ঘুমুতে হবে। আপার সঙ্গে ঘুমানো যায়। চিত্রার সঙ্গে ঘুমুতে যাবার একটাই সমস্যা চিত্রা গুটুর গুটুর করে সারারাতই গল্প করবে। হয়তো মীরা ঘুমিয়ে পড়েছে–চিত্রা খিলখিল করে হেসে উঠে বলবে, এই মীরা আজ কি হয়েছে শোন।
আপা ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
ঘুমঘুম চোখেই শোন।
প্লিজ।
না শুনলে না শুনবি। আমি বলে যাচ্ছি। তুই দুই হাতে কান চেপে পড়ে পাক। হয়েছে কি আমাদের সঙ্গে একটা ছেলে পড়ে তার নাম কামরুল হুদা। আমরা সবাই তাকে ডাকি কামরুল বেহুদা। স্মার্ট ছেলে, কাজের ছেলে, পড়াশোনাতেও ভালো। টাল্টুবাল্টু টাইপ না। সে একদিন আমার কাছে এসে বলল— চিত্রা সবাই আমাকে বেহুদা ডাকে। খুব ভালো কথা। তুমি বেহুদা ডাকবে কেন? আমি বললাম, সবাই ডাকলে যদি দোষ না হয়, আমি ডাকলেইবা দোষ হবে কেন? এই মীরা গল্পটা শুনছিস না ঘুমিয়ে পড়ছিস। আচ্ছা তারপর কি হয়েছে শোন–আমার কথা শুনে কামরুল বেহুদা কেমন যেন হয়ে গেল। তারপর আমাকে হতভম্ব করে দিয়ে ফট করে আমার হাত ধরে গদগদ গলায় বলল, চিত্রা তুমি এটা কি বললে?