আমাকে ধরবে কেন?
এতক্ষণ যে আমি তোমাকে ধরলাম–সবই মার কথা। মা বলেই রেখেছে আজ তোমাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে তুমি কিছু জান কিনা।
রহমান সাহেব চিন্তিত গলায় বললেন, ছেলের নাম বল। মনে করে রাখি।
ছেলের নাম আহসান খান। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। ছেলের বাবা জামালউদ্দিন খান। চাটার্ড একাউন্টেন্ট। এখন উনার নানান ব্যবসা আছে। আলফা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের উনি মালিক। ছেলের দাদা সাবিহউল্লাহ খান সোহরাওয়ার্দির আমলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন। মনে থাকবে?
একটা কাগজে লিখে দে। এত কিছু কি ভাবে মনে থাকবে?
সেটাই ভালো। লিখে দিচ্ছি। তুমি বসে বসে মুখস্ত কর। আজ তোমার মহাবিপদ। মা তোমার ওপর খুব রেগে আছে।
কেন?
কেনা তা যথাসময়ে জানলে এবং আমি মার সঙ্গে একমত। তোমার ওপর রাগ করার কারণ মার আছে।
রাত নটা বেজে গেছে চিত্রা তার মাকে নিয়ে এখনো ফেরে নি। রহমান সাহেবের ক্ষিধেয় নাড়ি খুলে যাচ্ছে। তিনি একটু চিন্তিত বোধ করছেন। আরো দেরি করলে তো রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে। তার সময় কাটছে না। ক্ষুধার্ত অবস্থায় কোনো কিছুই ভালো লাগে না। খবরের কাগজ পড়ার চেষ্টা করলেন। খবরের কাগজ পড়তে তার সব সময়ই ভালো লাগে। সকালবেলা যে কাগজ পড়েন, সন্ধ্যাবেলাও সেই একই কাগজ পড়তে পারেন। সকালবেলায় তিনি কি পড়েছেন, সন্ধ্যাবেলায় তা তার পরিষ্কার মনে থাকে না। মীরা কাগজে সে সব তথ্য দিয়ে গেছে, সেগুলি তিনি ভালো মতো মুখস্থ করে রেখেছেন। শায়লা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে তাকে আটকাতে পারবেনা। মীরা যে তাকে ঝামেলা থেকে বাঁচানোর জন্যে এত কিছু করবে তিনি ভাবতেই পারেন নি। তার কাছে মনে হচ্ছে এ রকম একটা মেয়ে থাকা যে কোনো বাবার জন্যেই ভাগ্যের ব্যাপার।
চিত্রা ফিরল রাত সাড়ে নটায়। ফিরেই সাবান তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। শায়লা বললেন, ভাত খেয়ে গোসলে যা। তোর গোসল তে এক ঘন্টার মামলা। এদিকে ক্ষিধায় মারা যাচ্ছি।
চিত্রা বলল, গা ঘিন ঘিন করছে। গোসল না করে খেতে পারব না।
শায়লা রহমান সাহেবের কাছে গিয়ে বললেন, তুমি সেজেগুজে বসে আছ কেন? কোথাও যাচ্ছ?
রহমান সাহেব ভীত গলায় বললেন, না।
তোমার কোনো বোনের বাসা থেকে ঘুরে আস না কেন? বোনের বাসায় চলে যাও।
কেন?
তোমার বোন আর দুপু্রে এ বাড়িতে এসেছিল। হাতে একটা আইসক্রিমের প্লাস্টিকের বাটি। বাটিতে দুই পিস ইলিশ মাছ। তুমি নাকি মাছ কিনে দিয়ে এসেছিলে। মাছ, সরিষা, কাঁচা মরিচ। তুমি যে ভাইবোনদের বাড়িতে বাজার করে দাও। তা তো জানতাম না।
রহমান সাহেব কিছু বললেন না। তিনি এমনিতেই ক্ষিধেয় অস্থির হয়ে ছিলেন। দুই পিস ইলিশ মাছের কথা শুনে ক্ষিদে আরো বেড়ে গেল।
শায়লা বললেন, তুমি নাকি তোমার বোনের ছেলেকে কম্পিউটার কিনে দিচ্ছ?
রহমান সাহেব অবাক হয়ে বললেন, কই না তো।
নিশ্চয়ই এ জাতীয় কথা বলছ–তোমার বোন তো বানিয়ে কথা বলছে না। কম্পিউটার নিয়ে তোমার বোনের সঙ্গে তোমার কোনো কথা হয়েছে, না হয় নি।
হয়েছে।
এই তো থলের বেড়াল বের হয়ে যাচ্ছে। বোনের ছেলেকে তুমি উপহার অবশ্যই দেবে। সেটা দেবে তোমার সামর্থ্য অনুযায়ী। কম্পিউটার কেনার সামর্থ্য কি তোমার আছে?
না নেই।
এক কাজ কর, রাত এমন কিছু বেশি হয় নি। তুমি তোমার বোনের বাসায় যাও। তাকে বুঝিয়ে বলে এসো–কম্পিউটার উপহার দেবার সামর্থ্য তোমার নেই। উপহার দিবে বলেছিলে, কিন্তু দিতে পারছ না।
এখনই যাব?
হ্যাঁ এখনি যাবে। তোমার বোনের দিয়ে যাওয়া ইলিশ মাছ আমি গরম করে রাখব। ফিরে এসে আরাম করে করে খাবে। বসে আছ কেন? উঠ। রহমান সাহেব উঠলেন। দিশাহারার মতো এগুলেন দরজার দিকে। শায়লা বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। আর যাওয়া বাদ দাও। কাল অফিস ফেরত অবশ্যই বোনের কাছে যাবে। তাকে ভালোমতো বুঝিয়ে বললে।
রহমান সাহেব ঘাড় কাত করলেন। তাঁর বুক থেকে পাষাণ ভার নেমে গেছে।
শায়লার মেজাদ খুবই খারাপ। এত যন্ত্রণা করে তিনি যে শাড়ি কিনেছেন–বাসায় এসে সেই শাড়ির রঙ তার পছন্দ হচ্ছে না। শাড়ির জমিনে হলুদ এবং সোনালির মাঝামাঝি রঙ। সেই রঙ এখন কেমন যেন ময়লা দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে পুরনো শাড়ি। আঁচলের সবুজ কাজটাও ভালো লাগছে না। হিজিবিজি লাগছে।
তার মেজাজ খারাপের আরো একটি কারণ হল, বাসায় পা দিয়েই তিনি দেখেছেন মীরা টেলিফোন করছে। মাকে দেখেই সে তড়িঘড়ি করে টেলিফোন নামিয়ে রেখে দ্রুত অন্য ঘরে চলে গেল। লক্ষণ মোটেই ভালো না। প্রেমের চারাগাছ শুরুতেই উপড়ে ফেলতে হবে। চারাগাছ উপড়ানোর কাজটা তিনি রাতে ঘুমুবার আগে আগে করবেন ভেবে রেখেছিলেন। এখন মত পাল্টালেন। কোনো কিছুই ফেলে রাখতে নেই। যখনকার কাজ তখন করতে হয়। তিনি মীরার ঘরে ঢুকে বললেন, মীরা খেয়েছিস?
মীরা বলল, না। রাতে খাব না।
খালি না কেন?
তরকারি পছন্দ না। টেংরা মাছের ঝোল বেঁধেছে। টেংরা মাছ আমার দু চক্ষের বিষ।
ডিম ভেঙে দিতে বল। ডিম ভাজা দিয়ে খা।
মীরা বলল, আচ্ছা।
শায়লা মেয়ের খাটে বসতে বসতে বললেন, ইতিদের বাসা কোথায় রে?
মীরা অবাক হয়ে বলল, কোন ইতি?
তোদের সঙ্গে পড়ে যে মেয়ে।
ওর বাসা কোথায় আমি কি করে জানব?
ইতির বাবা কি করেন?
আমি জানি না মা ইতির বাবা কি করেন।
শায়লা অনেকক্ষণ মেয়ের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলেন।
মীরা বলল, কি হয়েছে মা, এরকম করে তাকালে কেন?