বড় সাহেবের ভুরু কুঁচকে গেল। মুখের মধ্যে রাগ রাগ ভাল চলে এল। রাগ করার মতো কোনো কথা রহমান সাহেব বলেছেন কি না বুঝতে পারলেন না। বড় সাহেব টলিফোন রিসিভার নামিয়ে রেখে শুকনা মুখে বললেন, টেলিফোন নামালাম, এখন বলুন কি ব্যাপার।
রহমান সাহেব বললেন, একটা চাকরির ব্যাপারে এসেছি স্যার। বড় সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কি চাকরি?
একটা ছেলে স্যার। খুবই বিপদগ্রস্ত। অতি ভালো ছেলে। মেট্রিকে একটি ডিভিশন পেয়েছে, অংকে লেটার ছিল। ইন্টারমিডিয়েট রেজাল্ট সামান্য খারাপ হয়েছে, দশ নম্বরের জন্যে ফার্স্ট ডিভিশন পায় নাই।
বড় সাহেব কথার মাঝখানেই বললেন, হোল্ডে সেকেন্ড। আমরা কি চাকরির জন্য কোনো বিজ্ঞাপন দিয়েছি।
জ্বি না স্যার।
তাহলে আমাকে চাকরির কথা বলছেন কেন?
স্যার ছেলেটা আমাকেই চাকরির কথা বলেছে। আমি চাকরি কোথায় পাব? আপনারা বড় মানুষ, আপনাদের এত যোগাযোগ। যে কোনো চাকরি পেলেই চলবে–পিওন, দারোয়ান, টি বয়…
নাম কি ছেলের? নামটা স্যার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। মনে পড়লেই আপনাকে জানাব।
যে ছেলের চাকরির জন্যে সুপারিশ করছেন তার নামই মনে নেই। ছেলে কি আপনার আত্মীয়?
জি না ভাড়াটের চাচাতো ভাই। স্যার ছেলেটা খুবই কষ্টে আছে একটু দেখবেন। ক্লাস টু-থ্রি পর্যন্ত ছেলেমেয়েকে সে প্রাইভেট পড়াতে পারবে।
বড় সাহেন কিছু বললেন না। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলেন। রহমান সাহেব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, নামটা মনে পড়লেই আপনাকে জানিয়ে দিব। ইনশাল্লাহ আজ দিনের মধ্যেই জানাব।
ইমার্জেন্সি কিছু নেই। আজ দিনেই যে জানাতে হবে তা না।
রহমান সাহেব নিজের সিটে ফিনের ড্রয়ারটা খুলতেই নাম মনে পড়ল—মজনু। লাইলী মজনুর মজনু। তিনি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উপরে উঠে গেলেন। বড় সাহেবও লাঞ্চের জন্যে বের হচ্ছিলেন। তাকে নামটা জানিয়ে দিলেন। নামটা মনে পড়ছে স্যার। মজনু। লাইলী মজনুর মজনু। বড় সাহেব কিছু বললেন না। তবে তাকে দেখে মনে হলে তিনি রহমান সাহেবের কথাবার্তায় একধরনের মজা পাচ্ছেন।
অফিস দুটির পর রতন রং চা নিয়ে এল। রহমান সাহেব বললেন, আজ একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে। মেয়ে বাইরে খেতে নিয়ে যাবে, লন্ড্রি থেকে কাপড় আনতে হবে। গতকালের মতো ঝড় বৃষ্টি না হলেই হয়। বেচারী আশা করে আছে আমাকে নিয়ে যাবে— ঝড় বৃষ্টি হলে তো যেতে পারবে না। যাদের গাড়ি আছে তাদের অবশ্য কোনো সমস্যা নেই। ঝড় বৃষ্টি হলেই বরং তাদের সুবিধা। বৃষ্টি দেখতে দেখতে গাড়ি করে যাওয়া। কথা ঠিক বলেছি না রতন?
জ্বি।
তোমাকে কোনো একদিন একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নলব। মাছের বিষয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ কলা। আজই বলতাম, কিন্তু আমার আবার সকাল সকাল বাড়িতে ফেরা দরকার। কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে এটা আমি চাই না। আমি সবার জন্যে অপেক্ষা করব, কিন্তু আমার জন্যে কেউ যেন অপেক্ষা না করে। এটা ভালো বুদ্ধি না?
জ্বি।
তোমাকে যে ঘটনাটা বলব এটা গতকাল রাত আনুমানিক এগারোটার সময় ঘটেছে। আমার স্ত্রী চৌবাচ্চায় গোল্ডফিশ পুষে। সেই গোল্ডফিশ নিয়ে একটা ঘটনা। কাল পরশু যে কোনো একদিন বলব। আমি যদি ভুলে যাই তুমি মনে করিয়ে দিও।
জ্বি আচ্ছা।
আর বৃহস্পতিবারটা ফ্রি রেখ। তোমার এক জায়গাত দাওয়াত। দাওয়াতটা ক্যানসেলও হয়ে যেতে পারে। ক্যানসেল হলে মনে কষ্ট নিও না।
জ্বি আচ্ছা।
সন্ধ্যার আগেই রহমান সাহেব লাড়ি ফিরলেন। চিত্রা বাড়িতে নেই, মার সঙ্গে শাড়ি কিনতে গিয়েছে। বিকেলে গিয়েছে এখনো ফিরে নি। রহমান সাহেব ধোপার দোকান থেকে পাঞ্জাবি ইস্ত্রী করে আনলেন। মেয়ে বাড়ি ফেরার আগেই তৈরি হয়ে থাকবেন যেন তাঁর কারণে দেরি না হয়।
মীরা বলল, বাবা তুমি এমন সেজে তে বসে আছ কেন? দেখে মনে হচ্ছে বিয়ে বাড়িতে যায়।
রহমান সাহেব বাব দিলেন না। মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। রাতে বাইরে খেতে যাওয়ার কথা মীনাকে বলতে পারতেন। বললেন না, কারণ মীরা খেতে যাচ্ছে না। শুধু তিনি আর চিত্রা। এতে মীরা মনে কষ্ট পেতে পারে। অল্পবয়েসী মেয়েরা খুব সহজেই কষ্ট পায়।
মীরা বলল, যত দিন যাচ্ছে তুমি যে ততই বদলে যায় এটা কি জান! মাঝে মাঝে তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি আমাদের চিনতে পারছ না। মনে হয় তুমি এ বাড়ির কেউ না। তুমি একটা ফার্নিচার। আপার বিয়ে নিয়ে এত হৈচৈ, তুমি কিন্তু নির্বিকার। উত্তেজনায় মা রাতে ঘুমুতে পারছে না। তাকে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমুতে হচ্ছে। আর তুমি দিব্যি নিজের মতো আছ। যে ছেলের সঙ্গে আপার বিয়ে হচ্ছে তুমি তার নাম পর্যন্ত জান না।
নাম জানব না কেন? নাম জানি।
বল নাম বল।
রহমান সাহেব বিপদে পড়ে গেলেন। তিনি নাম মনে করতে পারছেন না। তাঁর মনে ক্ষীণ সন্দেহ হলো— নামটা তাকে বলাই হয় নি। নাম মনে করার চেষ্টা করতেই একটা নাম তার মনে পড়ল লাইলী মজনুর, মজনু। কিন্তু মজনু ছেলেটার নাম না।
কি চুপ করে আছ কেন? নাম বল।
ভুলে গেছি। আমার কিছু একটা হয়েছে। নাম মনে করতে পারি না। ঐ দিন অফিসে বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলছি— বড়সাহেব নাম জানতে চাইলেন। আর তো দেখি নাম মনে পড়ে না। কিছুক্ষণ পরে মনে পড়েছে।
তোমার ধারণা আপার বরের নাম তোমার কিছুক্ষণ পরে মনে পড়বে?
হুঁ।
মনে পড়লে তো ভালোই। আমাকে জানিও। আর যদি মনে না পড়ে সেটাও আমাকে জানিও। মা তোমাকে ধরবে।