এরচে ভালো সংবাদ আর কি হতে পারে? বরপক্ষের আসার কথা চারটায়। ওনা নিশ্চয় সময়মতো আসবে না। আসতে আসতে পাঁচটা বাজবে। কথাবার্তা বলা, নাশতা খাওয়া, এতে ছটা বেড়ে যাবে। তখন হঠাৎ শায়লা চমকে উঠে বলবেন, আশ্চর্য ভুলেই তো গেছি আজি টিভিতে চিত্রার প্রোগ্রাম আছে। এই তোরা কেউ টিভিটা ছাড় না।
বাসার টিভিটা খারাপ। মাঝে মাঝে র চলে যায়। টিভি ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট হয়ে যায়। উত্তরার বড় আপার টিভিটা এনে লাখতে হবে। তবে মেয়ের গান নিয়ে আদিখ্যাতা করা যাবে না। গানের মাঝখানে শায়লা উঠে যাবেন নিজের জন্যে চা বানিয়ে আনতে। চা নিয়ে ঢুকবেন গান শেষ হবার পর এবং বললেন, গান শেয় হয়ে গেল নাকি? যেন টিভিতে গান গাওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।
গানের অনুষ্ঠানের পর খুব স্বাভাবিক ভাবেই গান প্রসঙ্গে কিছুক্ষণ কথা হবে। তখন শায়লা বলবেন— ক্যাসেট কোম্পানিগুলি গানের ক্যাসেট বের করতে চায়। আমি রাজি না। মেয়ে তো একেবারেই রাজি না। তার কাছে গান হলো খুবই পার্সোনাল ব্যাপার। নিজের আনন্দের জন্যে গান করা। ক্যাসটে গান বের করা মানে মানুষের ঘরে ঘরে তার গলার স্বর পৌঁছে দেয়া–এটা নাকি চিত্রার ভালো লাগে না। আমি অবশ্যি এসব কিছু ভাবি না। তারপরেও কেন জানি ক্যাসেট বের করা আমার ভালো লাগে না।
চিত্রার কিছু বান্ধবীকে খবর দেয়া দরকার। যে কোনো উৎসবে মেয়েরা সেজেগুজে কলকল করতে থাকলেই উৎসবটা জমে। তবে খেয়াল রাখতে হবে কোনো মেয়েকেই যেন চিত্রার চেয়ে সুন্দরী না দেখায়। তখন সবার চোখ গিয়ে পড়বে ঐ মেয়ের দিকে।
কোনো একটা পার্লার থেকে চিত্রার চুলও সেট করে আনতে হবে। খুব সিম্পল ধরনের সেটিং। জবরজং দেখালে চলবে না, আবার ঘরে বসে হাত খোঁপা করে ফেলেছে এরকম মনে হলেও চলবে না।
কত সমস্যা। শালা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। তবে এই দীর্ঘ নিঃশ্বাসে আনন্দ মিশে রইল।
রহমান সাহেবকে অফিসে আজ একটু অস্থির দেখাচ্ছে। এগারটা বাজে নি এর মধ্যে তিনবার চা খেয়েছেন, দুবার জর্দা দিয়ে পান গেয়েছেন। চার খিলি পান আনিয়ে গেছেন। ইচ্ছা হলে খাবেন।
অফিসে কারো সঙ্গে তাঁর তেমন সদ্ভাব নেই। তবে অফিসের বেয়ারা রতনকে তিনি খুবই পছন্দ করেন। সে যখন চা বা পান নিয়ে আসে তার সঙ্গে তিনি সংসানের কিছু টুকিটাকি কথা বলেন। আজ রাতে তিনি বড় মেয়ের সঙ্গে চাইনিজ হোটেলে খেতে যাবেন এই কথা রতনকে বলেছেন। গলা নিচু করে প্রায় ফিসফিস করে বলেছেন–
হোটেলের পাওনা আমার খুবই অপছন্দ। বড় মেয়েটা একটা শখ করেছে এই জন্যে যাওয়া। ছেলেমেয়েদের শখের দিকটা বাবা মাকে দেখতে হয়।
রতন বেশির ভাগ সময়ই আলাপ-আলোচনায় অংশ নেয় না। তবে এমন ভাবে কথা শুনে যে মনে হয় খুব আগ্রহ নিয়ে কথা শুনছে। রহমান সাহেব ঠিক করেছেন অফিস ছুটির পর রতনকে কাল রাতে মাছের ব্যাপারটা বলবেন। কি ভাবে মাছটা তাকে বলল, আজ আমাদের খাবার দেয়া হয় নি। সে অবিশ্বাস করবে না, অন্য কাউকে বলে বেড়াবে না। অফিস ছুটির পরও রহমান সাহেব বেশ কিছুক্ষণ থাকেন। ফাঁকা অফিসে কিছুক্ষণ একা বসে থাকতে তার ভালো লাগে। তখন রতন তার জন্যে লেবু চা নিয়ে আসে। এই চায়ের দাম রতন কখনোই তাকে দিতে দেয় না। রহমান সাহেবের ইচ্ছা করছে মেয়ের এনগেজমেন্টে রতনকে দাওয়াত করতে। শায়লা তো বলেছে অফিসের কোনো কলিগকে বলতে ইচ্ছা করলে তিনি বলতে পারেন। তবে যদি প্রকাশ হয়ে পড়ে তা এখন পিওন তাহলে সমস্যা হতে পারে। রতন যদি ভালোমতো সেজেগুজে ফিটফাট হয়ে যায় তাহলে তাকে পিওন মনে হবে না। রতনকে তিনি দাওয়াতের কথা কিছু বলেন নি শুধু বলে রেখেছেন— বৃহস্পতিবারটা খালি রেখ। এক জায়গায় যেতে হতে পারে। রতন ঘাড় কাত করেছে। কোথায় যেতে হবে, কি ব্যাপার কিছুই জিজ্ঞেস করে নি।
লাঞ্চের মিনিট দশেক আগে রহমান সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। অফিসের বড় সাহেবের সঙ্গে তা বলা দরকার। লাবার সময় বড় সাহেব বাসায় লান্ত করতে যান। বেশির ভাগ সময়ই দেবেন না।
এই অফিসে সবাই বড় সাহেবের ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকে। তবে তিনি ভয় পান না। তিনি যথাসময়ে অফিসে আসেন, মন লাগিয়ে কাজ করেন, যথা সময়েরও পরে অফিস থেকে বাড়িতে যান। গত পাঁচ বছরে একদিনের জন্যেও দুটি নেন নি। তার টেবিলে কোনো পেন্ডিং ফাইল নেই। তার ভয় পাওয়ার কি আছে? তবে বড় সাহেবের চেহারা রাগী রাগী, গলার স্বরও রাগী। তিনি বড় সাহেবকে এমন কিছু বলতে যাচ্ছেন না যে বড় সাহেব রাগ করবেন এবং রাগী স্বর বের করবেন।
বড় সাহেব টেলিফোনে কথা বলছিলেন। পর্দা সরিয়ে এই দৃশ্য দেখে রহমান সাহেব ঠিক করতে পারলেন না, ঘরে ঢুকবেন নাকি ঢুকবেন না। কেউ টেলিফোনে কথা বললে হুট করে ঘরে ঢুকে পড়া ঠিক না। টেলিফোনে লোকজন অন্তরঙ্গ কথা বলে। বড় সাহেব হাতের ইশারায় রহমান সাহেবকে ঘরে ঢুকতে বললেন এবং ইশারা করলেন চেয়ারে বসার অন্যে। এটা একটা বিশেষ ভদ্রতা। বড় সাহেবের চেয়ে অনেক নিচের অফিসার সেকশনাল ইনচার্জ পরিমল বাবু এই ভদ্রতা করেন না। তার ঘরে কলে তিনি বসতে বলেন না। কেউ বসে পড়লে বিরক্ত হয়ে তাকান। বড় সাহেব টেলিফোন কানে রেগেই রাহমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, কি ব্যাপার?
রহমান সাহেব বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, স্যার আপনার কথা শেষ হোক তারপর বলি? এক সঙ্গে দুইজনের কথা শোনা মুশকিল।