মাথার টুপিটা খুললে হয়তো চিনবেন। আমি জয়নাল। একসঙ্গে ভিসা পেয়ে গেলাম।
বলো কী! তুমি জয়নাল!
আপনি যে আমাকে চিনতে পারেন নি এতে আপনাকে কোনো দোষ দেয়া যায় না। আমি নিজেই আজ সকালে নিজেকে চিনতে পারি নি। আয়নার সামনে দাড়িয়ে ক্যাপটা মাথায় দিয়ে হতভম্ব। আয়নায় যাকে দেখা যাচ্ছে লোকটা কে? Who is him? চাচাজি ইংরেজি কি ঠিক আছে? Who is him.
Who is he হবে।
ভুলভাল যাই হোক ইংরেজি বলে যাচ্ছি। ভাষাটা সরগর হয়ে থাক। আমেরিকানরা বুঝতে পারলেই হলো। আমার যুক্তিটা হচ্ছে চাচাজি, তোরা যখন আমাদের দেশে আসিস তখন তো বাংলা বলতে পারিস না–আমরা ভুলভাল যাই বলি তোদের ভাষাতেই বলি। ঠিক না?
হ্যাঁ ঠিক। জয়নাল বসো। তোমাকে দেখে ভালো লাগছে।
জয়নাল বসতে বসতে বলল, আমার ড্রেসটা কেমন হয়েছে চাচাজি?
খুবই ভালো।
জুতা বাদ দিয়ে কমপ্লিট ড্রেসে কত খরচ পড়েছে একটু আন্দাজ করেন তো? দেখি আপনার আন্দাজ।
এইসব বিষয়ে আমার একেবারেই আন্দাজ নাই। পাঁচ-ছয় হাজারের বেশি তো হবেই।
জয়নাল হাসি মুখে বলল, সর্বমোট ছয়শ একুশ টাকা খরচ পড়েছে। এর মধ্যে মার্কেটে যাতায়াতের আপ এন্ড ডাউন খরচ ধরা আছে। দুকাপ চা খেয়েছি, একটা সিঙ্গাড়া খেয়েছি, সেই খরচও আছে। তিন টাকা দিয়ে একটা বেনসন সিগারেটও কিনেছি। সব মিলিয়ে ছয়শ একুশ। আমার কথা বিশ্বাস করা না করা এখন আপনার ব্যাপার।
কোত্থেকে কিনলে?
আপনাকে নিয়ে যাব। আজই নিয়ে যাব। বঙ্গবাজার থেকে কিনেছি। আপনার জন্যেও কাপড়-চোপড় দেখে এসেছি। আমেরিকার মতো দেশে যাচ্ছেন। নেংটি পরে তো যেতে পারবেন না। আপনি তো আর মহাত্মা গান্ধি না যে খালি গায়ে নেংটি পরে প্লেন থেকে নামবেন। Coming down from the plane with goat, without cloth, only নেংটি। চাচাজি নেংটি ইংরেজি কী?
নেংটির ইংরেজি হলো loin cloth।
জয়নাল বিস্মিত হয়ে বলল, আপনি তো ইংরেজিতে মারাত্মক। নেংটির যে ইংরেজি আছে এইটাই আমি জানতাম না।
শামসুদ্দিন আন্তরিক গলায় বললেন, চা খাবে জয়নাল? ছেলেটার আনন্দ ঝলমল মুখ দেখতে তার ভালো লাগছে।
জয়নাল বলল, চা অবশ্যই খাব। চলুন চা খেয়ে বের হয়ে পড়ি।
কোথায়?
কী বললাম একটু আগে? বঙ্গবাজার যাব। We go to bengali bazar।
আজই কিনতে হবে?
অবশ্যই। দুটা ওভারকোট দেখে এসেছি। গায়ে দিয়ে বরফের চাং-এর উপর শুয়ে থাকলেও কিছু হবে না। উল্টা ওভারকোটের গরমে আপনি ঘামবেন। গরমের চোটে সর্দি গর্মি হয়ে যেতে পারে। চাচাজি, আপনার কাছে সুই-সুতা আছে? হলুদ সুতা লাগবে।
কেন বলো তো?
ব্লেজারের একটা বোতাম খুলে গেছে। বোতাম লাগাতে হবে। ব্লেজার, টপি, টাই সৰু আপনার এখানে রেখে যাব। কোনো অসুবিধা আছে?
না, অসুবিধা নাই। আমার এখানে রাখবে কেন?
আর বলবেন না–আমি যেখানে থাকি গতরাতে সেখানে চুরি হয়েছে। আমার স্যুটকেস নিয়ে চলে গেছে। আল্লাহপাকের অসীম রহমত পাসপোর্টটা সুটকেসে ছিল না। একবার ভেবেছিলাম স্যুটকেসে রাখি। যদি রাখতাম উপায়টা কী হতো বলেন দেখি? আমেরিকান ভিসা লাগানো পাসপোর্ট বাজারে পাঁচ লাখ টাকায় বিকিকিনি হয়।
কী বলল তুমি?
যা বলছি একশ ভাগ খাঁটি কথা বলছি। Hundred percent truth speaking। জাপানি ভিসা লাগানো পাসপোর্ট বিকিকিনি হয় ছয় লাখে। ওদেরটা এখন একটু বেশি দাম যাচ্ছে।
ভিসা লাগানো পাসপোর্ট দিয়ে কী করা হয়?
পাসপোর্টের ছবি পাল্টে অন্য ছবি বসিয়ে দেয়া হয়। এমনভাবে কাজটা করা হয় যে কার বাপের সাধ্যি কিছু বুঝে। মনে করুন, আপনি আপনার পাসপোর্টটা বিক্রি করে দিলেন খোদেজা বেগমের কাছে। পাসপোর্টে আপনার ছবি পাল্টে লাগানো হবে খোদেজা বেগমের ছবি। এই পাসপোর্ট দেখিয়ে খোদেজা বেগম চলে যাবে আমেরিকায়। সে সেখানে এক সময় না এক সময় সিটিজেন হয়ে যাবে। তারপর সে তার আত্মীয়স্বজন একে একে আমেরিকায় টানতে শুরু করবে।
এরকম হয় নাকি?
অবশ্যই হয়। হয় এবং হবে। আমি সবই জানি। গত নয় বছর তো এইটা নিয়েই আছি, জানব না কেন বলুন! চাচাজি, চা আর সুই-সুতা তাড়াতাড়ি নিয়ে আসুন। বঙ্গবাজার চলে যাই। বঙ্গবাজার থেকে যাব ট্রাভেল এজেন্সিতে। আমার দূরসম্পর্কের এক মামা ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করেন। সবচে কম দামে টিকিটের ব্যবস্থা করে দেবেন। বুকিং দিয়ে রাখি। বুকিং দিতে টাকা পয়সা লাগবে না।
ওভারকোট পাওয়া গেল না। বিক্রি হয়ে গেছে। জয়নালের মেজাজ খুবই খারাপ। দুটা গোলাপি রঙের মাফলার অবশ্যি কেনা হলো। তাতেও জয়নালের খুঁতখুঁতানি।
বুঝলেন চাচাজি, গোলাপি রঙের মাফলার কেনা ঠিক হয় নি। আমেরিকায় গোলাপি হলো মেয়েদের রঙ।
শামসুদ্দিন খুবই বিস্মিত হয়ে বললেন, মেয়েদের রঙ বলে আলাদা কিছু আছে নাকি?
আমেরিকায় আছে। আমেরিকায় গোলাপি হলো মেয়েদের রঙ, নীল হলো ছেলেদের রঙ। বড়ই আজিব দেশ।
তাই তো দেখছি।
এখন আর কী দেখছেন–কেনেডি এয়ারপোর্টে পা দেবার পর মাথা ঘুরে। ধরাস করে পড়ে যাবেন। প্রতি সেকেন্ডে সেখানে একটা করে বিমান আকাশে উড়ছে, একটা নামছে। কম্পিউটার সব কনট্রোল করছে বলে রক্ষা। নিউ ইয়র্কের রাস্তাঘাটের এমন অবস্থা যে আমেরিকানদেরও মাথা আউলা হয়ে যায়। অন্য স্টেটের লোকজন পারতপক্ষে নিউ ইয়র্ক আসতে চায় না।
আমরা তো প্রথমে নিউ ইয়র্কেই যাচ্ছি।
অবশ্যই। আপনি মোটেই দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি আছি। স্ট্যাচু অব লিবার্টি যা যা আছে আমিই সব দেখাব। স্ট্যাচু অব লিবার্টি দ্বীপের ভেতর। ফেরিতে করে যেতে হয়।