এই ধরনের উদ্ভট চিন্তা করিস না।
বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়। বাতি জ্বালানো থাকলে কোনোদিনই ঘুম আসবে না। আমার কাছে ঘুমের ওষুধ আছে। ঘুমের ওষুধ দেব?
না।
রাহেলা শামসুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, ভাইজনি শোন, তোমাকে গোপন একটা কথা বলি–আমার কাছে সাতচল্লিশটা ঘুমের ট্যাবলেট আছে।
শামসুদ্দিন বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন?
রাহেলা বলল, ঘুমের ওষুধ মানুষ কী জন্যে রাখে? ঘুমাবার জন্যে। আমি ঠিক করে রেখেছি আমার পেটে যে যন্ত্রণাটা আছে সেই যন্ত্রণা খালীস হবার পর আমি শান্তিমতো ঘুমাব। দুই তিনটা ট্যাবলেটে শান্তির ঘুম হবে না। ঘুম ভেঙে যাবে। ঘুম যাতে না ভাঙে সেই ব্যবস্থা নিয়ে ঘুমাব।
তোর মাথা আসলেই খারাপ হয়েছে।
মাথা খারাপ হয় নাই ভাইজান। মাথা খারাপ মানুষ ঘুম-অঘুম নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাদের কাছে ঘুমও যা জেগে থাকাও তা। সুস্থ মানুষই ঘুম-অঘুম নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে। আমি খুবই সুস্থ মানুষ। ভাইজান, বাতি নিভিয়ে ঘুমাতে যাও।
রাহেলা তার ঘরে ঢুকল। সেখানেও বাতি জ্বলছে। খাটে পা ঝুলিয়ে রফিক বসে আছে। রফিকের গা ঘেঁসে পৃথু বসে আছে। সে গম্ভীর ভঙ্গিতে পা দোলাচ্ছে। মাকে দেখে সে পা দোলানো বন্ধ করল। ভীত চোখে তাকিয়ে রইল মার দিকে। পৃথুর বয়স সাত বছর। সে মাকে খুবই ভয় পায়।
রফিক বলল, বিরাট দুর্ঘটনা ঘটেছে। পৃথু বিছানা ভিজিয়ে ফেলেছে। ভেজা বিছানায় তো আর শোয়া সম্ভব না কাজেই তাকে আমাদের বিছানায় নিয়ে এসেছি। সে আমাদের দুজনের মাঝখানে হাইফেন হয়ে শুয়ে থাকবে। কী রে বাবা, পারবি না?
পৃথু প্রবল বেগে মাথা নেড়ে জানাল যে সে পারবে। রাহেলা কঠিন গলায় বলল, গরমের মধ্যে চাপাচাপি করে তিন জন ঘুমাতে পারব না। পথু তার নিজের ঘরেই ঘুমাবে। ভেজা বিছানাতে শুয়ে থাকবে। এটা তার বিছানা ভেজাননার শাস্তি। এত বড় ছেলে হয়েছে এখনো বিছানা ভেজানো? তাকে তো কানে ধরে চাবকানো দরকার।
রফিক বলল, ইচ্ছা করে তো বিছানা ভেজায় না। রাহেলা শোন, ও একা। ঘুমুতে ভয় পাচ্ছে, আমি ওর সঙ্গে গিয়ে ঘুমাই।
রাহেলা কঠিন গলায় বলল, তুমি আমার সঙ্গে এই ঘরে থাকবে।
নো প্রবলেম। এক কাজ করলে কেমন হয় তোমরা দুজন খাটে শোঁও, আমি মেঝেতে কম্বল পেতে শুয়ে পড়ি।
রাহেলা জবাব দিল না। রফিক আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, এত রাতে ভাইজানের সঙ্গে কী নিয়ে আলাপ করছিলে?
রাহেলা বলল, ভয় নাই, কোনো ষড়যন্ত্র করছিলাম না। ভাইজান ষড়যন্ত্রের মানুষ না।
রফিক বলল, কী বলছ! ষড়যন্ত্রের কথা আসছে কেন?
যে যে-রকম, অন্যকে সে সে-রকমই ভাবে। এই জন্যেই ষড়যন্ত্রের কথা আসছে। তুমি যে আমাকে আর ভাইজানকে নিয়ে সন্দেহ কর এটাও আমি জানি।
রফিক বিস্মিত হয়ে বলল, সন্দেহ কেন করব? ছিঃ ছিঃ।
কথায় কথায় ছিঃ ছিঃ করবে না। তোমার মন যে কত ছোট সেটা আর কেউ জানলেও আমি জানি।
রফিক চুপ করে গেল। পৃথু আবার পা দোলাতে শুরু করেছে। তাকে একা একা আলাদা একটা ঘরে ঘুমুতে হবে না এই আনন্দেই সে আনন্দিত। মেঝেতে যখন বিছানা হচ্ছে তখন এই বিষয়টা নিশ্চিতই হচ্ছে। পৃথুর ইচ্ছা করছে বাবার সঙ্গে ঘুমুতে। মেঝের বিছানাটা বেশ ভালো হচ্ছে। তাছাড়া বাবার সঙ্গে ঘুমানোর আনন্দ আছে। বাবার উপর পা তুলে দিলে ৰাৰা কিছুই বলে না। মায়ের গায়ে পা তোলা যায় না। মা ধমক দিয়ে বলেন–গাদা পা সরা। গাবদা পা জিনিসটা কী পৃথু জানে না। তারপরেও সে নিশ্চিত যে তার পা গাবদা না। পৃথুর পা মোটেই গাবদা না।
রাহেলা বাথরুমে ঢুকে গেছে। কল ছেড়ে দিয়ে ক্রমাগত মুখে পানি ঢালছে। প্রায়ই তার শরীর জ্বালা করে। এই সময় মুখে পানি দিতে হয়।
কলের পানির শব্দটা পৃথুর ভালো লাগছে। বাবার সঙ্গে এখন ফিস ফিস করে কথা বললে মা শুনতে পাবে না। পৃথু চাপা গলায় ডাকল, বাবা।
রফিক ছেলের দিকে তাকিয়ে পৃথুর মতোই গলা চাপা করে বলল, কী?
আমি তোমার সঙ্গে ঘুমুব।
খুবই ভালো কথা। আমাকে ভিজিয়ে দিবি না তো?
না। বাবা, গাবদা পা মানে কী?
গাবদা পা মানে হলো গাধার পা।
আমার পা কি গাবদা?
তুই যদি গাধা হোস তাহলে তোর পা গাবদা। তোর হাত তাহলে হবে গাবহা। আর মুখ হবে গাবমু।
পৃথু শব্দ করে হেসে উঠল। বাবা এমন মজার মানুষ। বাবার মতো মানুষ। পৃথিবীতে আর তৈরি হয় নি। কোনোদিন হবেও না।
মানুষটাকে চেনা চেনা লাগছে
মানুষটাকে চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু ঠিকমতো চেনা যাচ্ছে না। তার কী নাম, তার সঙ্গে কোথায় দেখা হয়েছে কিছুই মনে পড়ছে না। শামসুদ্দিন অস্বস্তি নিয়ে তাকিয়ে আছেন। তাঁর সামনে দাঁড়ানো মানুষটা রীতিমতো সুটেট বুটেট। সোনালি রঙের ব্লেজার, লাল টাই। মাথায় হালকা নীল রঙের ক্যাপ। সোনালি ফ্রেমের সানগ্লাসে চোখ ঢাকা।
মানুষটা শামসুদ্দিনের পা ছুঁয়ে সালাম করল। বিনীত ভঙ্গিতে হাসল। শামসুদ্দিন খুবই বিব্রত বোধ করছেন। সুটেট-বুটেট ধরনের কারো সঙ্গে তার পরিচয় আছে বলেই মনে পড়ছে না।
চাচাজি, আমাকে চিনেছেন?
না।
সানগ্লাসটা খুললে চিনবেন। সানগ্লাস পরা থাকলে মানুষকে চেনা যায় না। সিনেমার নায়ক-নায়িকারা এই জন্যে সানগ্লাস পরে থাকে। পাবলিক চিনতে পারে না।
লোকটা সানগ্লাস খুলে হাসিমুখে তাকিয়ে বলল, এখন চিনেছেন?
না।
সুটেট বুটেট মানুষটাকে খুবই আনন্দিত মনে হলো। যেন তাকে চিনতে না পারা খুবই আনন্দময় ঘটনা।