রাত প্রায় বারোটা। তিনি এখনো জেগে আছেন। তার সামান্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে। যদি রাত একটার ভেতর ঘুম না আসে তাহলে বাকি রাত আর ঘুম হবে না। এই বয়সে অদ্রিা রোগ হয়। এটা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার না, বরং একদিক দিয়ে ভালো–নানান বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করা যায়। তার চিন্তা করতে খারাপ লাগে না তবে তার সমস্যা হলে ছোট্ট ঘরটার ভেতর বসে থাকতে হয়। তার ঘরটা মৃল বাসার সঙ্গে যুক্ত না। আলাদা। মূল দরজা বন্ধ করে দিলে তাকে তার ঘরেই বসে থাকতে হয়। বারান্দাও নেই যে বারান্দায় গিয়ে দাড়াবেন। তাঁর ঘরটা যদি মূল বাড়ির অংশ হতো তাহলে অনিদ্রা রোগে কোনো সমস্যা হতো না। হাঁটাহাঁটি করতে পারতেন। চা খেতে ইচ্ছা হলে রান্নাঘরে চুপি চুপি চলে যেতেন। নিঃশব্দে চা বানিয়ে বসার ঘরের বেতের সোফায় বসে থাকতেন। তাঁর নিজের একটা ছোটখাটো টিভি থাকলে ভালো হতো। টিভিটা মশারির ভেতর নিয়ে খাটে আধশোয়া হয়ে টিভি দেখতেন। আজকাল নানান চ্যানেল হয়েছে। সারারাতই না-কি টিভি চলে।
একটা বেজে গেছে। ঘুম আর হবে না। শামসুদ্দিন খটি থেকে নামলেন। বাতি জ্বালালেন। আবার এসে মশারির ভেতর ঢুকে পড়লেন। অদ্রিার রোগী কখনো অন্ধকারে খাকতে পারে না।
কোনো একটা বিষয় নিয়ে এখন আয়োজন করে চিন্তা শুরু করা যেতে পারে। চৈতার বাপ নিয়েই চিন্তা করা যায়। আচ্ছা, আদর করে কেউ কখনো নিজের ছেলেকে চৈতার বাপ ডাকে? চৈতাটা কে? কোনো মানুষের নাম, নাকি চৈত্র মাস থেকে চৈতা? তার জন্য তো চৈত্র মাসে হয় নি। জন্ম হয়েছে আষাঢ় মাসে। তাহলে নাম চৈতার বাপ কেন? তার মন খারাপ লাগছে বাবাকে এই প্রশ্নটা করা হয় নাই।
খট করে শব্দ হলো। কে যেন সদর দরজা খুলল। খালি পায়ে এগিয়ে আসছে। কে হতে পারে? শামসুদ্দিন সাহেব কান খাড়া করলেন। তার ঘরের দরজায় কে যেন হাত রাখল। শামসুদ্দিন বললেন, কে?
রাহেলা বলল, ভাইজান আমি। দরজা খুলুন।
শামসুদ্দিন দরজা খুললেন। রাহেলা বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। শামসুদ্দিন বললেন, কী হয়েছে? রাহেলা বলল, আমার কিছু হয় নি। তোমার কী হয়েছে বলো। রাত দুটা বাজে, বাতি জ্বালিয়ে রেখেছ কেন?
ঘুম আসছে না।
বাতি জ্বালিয়ে রাখলে ঘুম আসবে কেন? বাতি নিভিয়ে শুয়ে থাকলেই না ঘুম আসবে।
রাহেলা ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসতে বসতে বলল, তোমার আমেরিকা যাবার তারিখ কি ঠিক হয়েছে?
না।
মনে করে তুমি ভোমার হাঁচি রোগের চিকিৎসা করে আসবে। ওদের চিকিৎসা নিশ্চয়ই ভালো।
চিকিৎসা ভালো হলেও খুবই খরচান্ত ব্যাপার। আর হাঁচি রোগ এমন না যে চিকিৎসা না হলে মারা যাব।
এক নাগাড়ে একশ হাঁচি দাও–এই রোগ খারাপ না তো কোন রোগ খারাপ? ভাগ্যিস তুমি বিয়ে কর নি।
বিয়ে করলে সমস্যা কী হতো?
বাসর রাতে একশ দেড়শ ঘঁচি দিতে। হাঁচি শুনে বউ-এর কলজে শুকিয়ে যেত।
শামসুদ্দিন কিছু বললেন না। রাহেলার গোলগাল মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বড় বড় চোখ। গোলগাল মুখ। মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল। তার মুখে শিশুসুলভ সরলতা আছে। মানুষের চিন্তা চেতনা থেকে সারল্য চলে যায় কিন্তু তারা তা চেহারায় ধরে রাখে। রাহেলা তার চেহারায় ধরে রেখেছে।
ভাইজান, আমার প্রায়ই কি মনে হয় জানো? আমার মনে হয় মার কথাটা আমার শোনা উচিত ছিল। মার কথা না শুনে বিরাট ভুল করেছি।
উনার কোন কথা?
রাহেলা মাথা নিচু করে অস্পষ্ট স্বরে বলল, মারা যাবার আগে আগে মা আমাকে বলল তুই শামসুকে বিয়ে করিস। সে আলভুলা মানুষ। তোর হাতে থাকলে ঠিক থাকবে।
শামসুদ্দিন চুপ করে গেল। খুবই অস্বস্তিকর একটা প্রসঙ্গ। রাহেলা এই প্রসঙ্গ মাঝে মাঝেই তুলে।
রাহেলা বিড়বিড় করে বলল, তুমি বয়সে আমার অনেক বড়, তারপরেও আমার কোনো আপত্তি ছিল না। মা মরার সময় একটা কথা বলে গেছে আমি আপত্তি করব কেন? কিন্তু মা যে এই কথা আমাকে বলে গেছে এই কথাটাই কেউ বিশ্বাস করল না। সবাই ভাবল আমার মধ্যে কোনো সমস্যা আছে। এই জন্যেই বানিয়ে বানিয়ে এই ধরনের কথা বলেছি। আমাকে নিয়ে সবার কী হাসাহাসি!
শামসুদ্দিন বললেন, রাহেলা ঘুমুতে যা, রাত অনেক হয়েছে।
রাহেলা বলল, ভাইজান রাত জাগলে ক্ষিধে পায়। তোমার কি ক্ষিধে পেয়েছে?
না।
রাতে ভালোমতো খেতেও পার নি। আমার উল্টাপাল্টা কথা শুনে তোমার খাওয়া হয়ে গেল বন্ধ।
ঠিকমতোই খেয়েছি। কৈ মাছের ঝোল খুব ভালো হয়েছিল।
এক পিস কৈ মাছ এখনো আছে। ভাত গরম করে আনি, খাও।
আরে না! তুই পাগল না-কি! এক রাতে কয়বার খাব?
যতবার ক্ষিধে লাগবে ততবার খাবে। আমার যখন ঘুম হয় না তখন রাতে ক্ষিধে লাগে। আমি ভাত গরম করে ডিম ভেজে খেয়ে নেই।
তোরও কি অনিদ্রা রোগ আছে?
রাহেলা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, যে মানুষের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে অনিদ্রা রোগ তো হবেই। এখন আমি পৃথুর বাবাকে পাহারা দেবার জন্যে জেগে থাকি। ভান করি যেন ঘুমিয়ে পড়েছি। আসলে জেগে থাকি।
এরকম করলে তো তার শরীর খারাপ করবে। এই সময়ে শরীর খারাপ করা ঠিক না।
রাহেলা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, আমি চাই শরীর খারাপ হোক। আমার বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে না ভাইজান। অনেক দিন থেকেই করে না। কতজনের কাছে শুনি পোয়াতি অবস্থায় বাথরুমে পা পিছলে পড়েছে। এবরশন হয়ে গেছে। রক্ত যেতে যেতে মৃত্যু। আমি আমার বাথরুমটা ইচ্ছা করে পানি দিয়ে সারাক্ষণ ভিজিয়ে রাখি। পৃথুর বাবা দুদিন পা পিছলে পড়ে ব্যথা পেয়েছে। আমার এখন পর্যন্ত কিছু হয় নি।