রাতের খাবার শেষ করে ঘণ্টাখানিকের মধ্যেই শামসুদ্দিন শুয়ে পড়েন। রফিকের সঙ্গে তার দেখাই হয় না। সে কখনো রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটার আগে বাসায় ফিরে না। যেদিন সকাল সকাল বাড়ি ফেরে সেদিন রফিক অবশ্যই একবার শামসুদ্দিনের ঘরে আসে। বিছানায় পা তুলে বসে জমিয়ে গল্প করে। পান সিগারেট খায়। সময়টা শামসুদ্দিন সাহেবের ভালো কাটে। রফিক মাঝে মাঝে এমন সব হাসির গল্প বলে যে হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা শুরু হয়।
শামসুদ্দিন ঘড়ি দেখলেন। দশটা চল্লিশ। রফিক আজ সকাল সকাল ফিরেছে। কাজেই একবার নিশ্চয়ই তার ঘরে আসবে। যদি আসে তাহলে কি তিনি তার সঙ্গে সহজভাবে কথা বলতে পারবেন? তিনি খুবই অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। সবচে ভালো হয় তিনি যদি বাতি নিভিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েন। রফিক নিশ্চয়ই গল্প করার জন্যে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলবে না। পরপর কয়েকদিন দেখা না হলে খুব ভালো হয়। এর মধ্যে রাহেলা তার ভুল বুঝতে পারবে। কাজের মেয়েটাকে বিদায় করার একটা ব্যবস্থাও করতে হবে।
ভাইজান জেগে আছেন?
বলতে বলতে রফিক হাসি মুখে ঢুকল। তার মুখ ভর্তি পান। মুখ থেকে জর্দার গন্ধ আসছে। হাতে দুটা সিগারেট। শামসুদ্দিনের দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিতে দিতে রফিক বলল, বিয়ে খেয়ে এসেছি। এলাহী ব্যবস্থা। বিয়ের খাওয়ার পর চা কফি আছে, পান আছে। দুটা বাচ্চা মেয়ে আবার ট্রে ভর্তি সিগারেট নিয়ে ঘুরছে। যার ইচ্ছা সিগারেট নিচ্ছে। আমার ইচ্ছা ছিল এক সঙ্গে চারপাঁচটা নেই। শেষে লজ্জা লাগল, দুটা নিলাম। ডানহিল সিগারেট। দুটাই রেখে দিয়েছি আপনার সঙ্গে খাব বলে।
শামসুদ্দিন ক্ষীণ গলায় বললেন, কার বিয়ে?
আমার এক বন্ধুর শালার বিয়ে। ট্রাকের ব্যবসা করে দুহাতে মাল কামিয়েছে। শরীর থেকে কাঁচা টাকার গন্ধ আসছে। ভাইজান, আপনি নাকি আমেরিকা যাচ্ছেন? রাহেলার কাছে শুনলাম। সত্যি নাকি?
হুঁ।
খুব ভালো। ভিসা হয়েছে?
হুঁ।
তাহলে ভাইজান আমার একটা উপদেশ শোনেন। আমেরিকার মাটি কামড়ে পড়ে থাকবেন। দেশে আসার নামও করবেন না।
তা কী করে হয়! ঐ দেশে আমি করব কী?
কিছুই করতে হবে না। মাটি কামড় দিয়ে পড়ে থাকবেন। যদি দেখেন কিছুই হচ্ছে না, না খেয়ে আছেন তাহলে কোনো এক আমেরিকান মহিলাকে সবার সামনে চড় লাগাবেন, মুখে থুথু দিয়ে দেবেন।
কেন?
এতে লাভ আছে। পুলিশ এসে আপনাকে ধরে নিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দেবে। আরামে জেলে থাকবেন। ওদের জেলখানাও আমাদের থ্রি স্টার হোটেলের মতো। এলাহি কারবার। সকালে ব্যবস্থা আছে। সপ্তাহে তিনটা মুভি দেখায়। প্রতিদিন বিকেলে খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে। খাবার খুবই ভালো।
তুমি ওদের জেলের ব্যাপার জানলে কীভাবে?
ছবিতে দেখেছি। কমনসেন্স সে-রকমই বলে। বেহেশতে যদি জেলখানা থাকে সেই জেলখানাও তো বেহেশতের মতোই হবে।
আমেরিকা বেহেশত নাকি?
অবশ্যই বেহেশত।
শামসুদ্দিন রফিকের দিকে অবাক হয়েই তাকিয়ে আছেন। কী সুন্দর রাজপুত্রের মতো চেহারা। কী সুন্দর হাসিখুশি স্বভাব। রাহেলা ভুল করছে। অভাবে স্বভাব নষ্ট যে বলে তাই হয়েছে। রাহেলার স্বভাব নষ্ট হয়ে গেছে। মন হয়েছে ছোট। যা দেখছে সবই ছোট চোখে দেখছে।
ভাইজান।
হুঁ।
আপনাকে চিন্তিত লাগছে কেন?
চিন্তিত না তো।
অবশ্যই আপনি চিন্তিত। দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন করতে হবে ভাইজান। আমাদের সকল সমস্যার মূলে আছে দুশ্চিন্তা। ব্লাড প্রেসার, হার্টের অসুখ, ডায়াবেটিস… শুরুটা দুশ্চিন্তায়।
তোমার ব্যবসা বাণিজ্যের অবস্থা কী?
ভালো না! লাক ফেভার করছে না। এক জ্যোতিষীকে হাত দেখিয়েছিলাম; সে বলল, আরো দুই বছর এই অবস্থা যাবে। তৃতীয় বছর থেকে পালে বাতাস লাগবে। দুটা বছর পার করাই সমস্যা। আপনাকে দেখে ভাইজান হিংসা হয়–একা মানুষ, নিজেই সরকার প্রধান, নিজেই বিরোধী দলের প্রধান। যখন যা ইচ্ছা করতে পারেন। ঐ গানটা শুনেছেন। স্ত্রী হইল হাতের বেড়ি পুত্র ঘরের খিল?
না।
খুবই বাস্তব গান। আপনি গানের মর্ম বুঝবেন না, কারণ আপনার স্ত্রী পুত্রের কারবারই নাই। আমারা যারা বিবাহিত তারা এই গানের মর্ম হাড়ে হাড়ে বুঝি।
অসুখী বিবাহিত পুরুষ হয়তো বুঝে। সুখী যারা তাদের বোঝার কথা না। তাদের কাছে সংসার অতি আনন্দের ব্যাপার।
রফিক খাট থেকে নামতে নামতে বলল, সংসার কোনো আনন্দের ব্যাপার
ভাইজান। খুবই নিরানন্দের ব্যাপার। সংসার মানেই দ্বীপান্তর। যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর। যাই, আপনি ঘুমিয়ে পড়েন।
শামসুদ্দীন মুবার আয়োজন করলেন। মশারির ভেতর তিনি ঘুমাতে পারেন না। বাধ্য হয়ে কিছুদিন ধরে মশারির ভেতর ঘুমাতে হচ্ছে। খুব মশার উপদ্রব। তিনি মশারি ফেলে মশারির ভেতর ঢুকে পড়লেন। বালিশের কাছে এক বোতল পানি রাখলেন। দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙলেই তার পানির পিপাশা হয়। সঙ্গে সঙ্গে পানি না খেলে মনে হয় বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। দুঃস্বপ্ন ইদানীং ঘন ঘন দেখছেন। একটাই দুঃস্বপ্ন–তিনি ট্রেন লাইন দিয়ে হাঁটছেন, পেছনে ট্রেন ছুটে আসছে। তিনি দৌড়াতে শুরু করেছেন। ট্রেন লাইন থেকে নেমে গেলে হয়। তিনি নামছেন না, লাইন বরাবর দৌড়াচ্ছেন। পেছন থেকে আসছে আন্তঃনগর ট্রেন। এই স্বপ্নটাই নানান ভাবে নানান ভঙ্গিমায় দেখছেন। কখনো তিনি একা। কখনো তার হাত ধরে থাকে বাচ্চা একটা ছেলে। কখনো বা দেখেন তিনি রেল লাইনের স্লিপারে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন।