রাহেলা এসে তাঁর সামনে বসেছে। শামসুদ্দিন তার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হকচকিয়ে গেলেন। রাহেলার মুখ থমথম করছে। রফিকের সঙ্গে বড় ধরনের কোনো ঝগড়াঝাটি নিশ্চয়ই হয়েছে। কিছুদিন পরপর ওরা ঝগড়া করছে। খুব ভুল কাজ হচ্ছে। রাহেলার সন্তান হবে। ছয় মাস চলছে। এই সময় মায়ের মেজাজ খারাপ থাকলে মায়ের পেটের সন্তানের ক্ষতি হয়।
শামসুদ্দিন বললেন, রাহেলা মন খারাপ নাকি?
রাহেলা চাপা গলায় বলল, না।
মুখ এত গম্ভীর করে রেখেছিস কেন? শরীর খারাপ লাগছে? শরীর খারাপ লাগলে রেস্ট নে। শুয়ে থাক। আমার সামনে বসতে হবে না। একা খেয়ে আমার অভ্যাস আছে।
রাহেলা সরাসরি শামসুদ্দিনের চোখের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল, ভাইজান, তুমি নাকি আমেরিকা যাচ্ছ?
শামসুদ্দিন ক্ষীণ গলায় বললেন, হুঁ।
কবে যাচ্ছ?
যাওয়ার তারিখ এখনো ঠিক হয় নি। ভিসা হয়ে গেছে। এখন ইচ্ছা করলে যে-কোনো দিন যেতে পারি। বিমানের টিকিট কাটতে হবে।
টিকিট কাটতে কত লাগবে?
ঠিক জানি না। সত্তুর আশি হাজার টাকা লাগবে।
আমেরিকায় থাকবে কোথায়?
সস্তার হোটেল মোটেল খুঁজে বের করব। আমার কিছু ছাত্র আছে। ওদের ঠিকানা নিয়ে যাব।
আমেরিকায় যাচ্ছ কেন?
এই এমনি আর কী। বেড়াতে যাচ্ছি। এই জীবনে কিছুই তো দেখলাম না। নিজের দেশের দক্ষিণের পুরোটাই সমুদ্র। সেই সমুদ্রও দেখা হলো না।
শুধু বেড়ানোর জন্যে আমেরিকা যাচ্ছ?
শামসুদ্দিন চুপ করে রইলেন। শুধু বেড়ানোর জন্যে আমেরিকা যাচ্ছেন এটা বললে মিথ্যা বলা হবে। সামান্য বিষয় নিয়ে মিথ্যা বলা ঠিক হবে না।
রাহেলা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, তুমি আমেরিকায় যাবে এই খবরটা গোপন করলে কেন?
শামসুদ্দিন ব্ৰিত গলায় বললেন, গোপন করি নি তো। গোপন করব কেন?
অবশ্যই তুমি গোপন করেছ। তুমি যে আমেরিকায় যাবার প্ল্যান করেছ সেটা কাউকে জানাও নি। পাসপোর্ট করেছ, ভিসা করেছ–তাও জানাও নি। আমি জিজ্ঞেস করে জানলাম। এখন বলো কেন আমার কাছে গোপন করলে? আমি তোমার আপন বোন না। অনেক দূরের বোন। এই জন্যে?
বলার সুযোগ হয় নি। ভিসা পাব কী পাব না তারই ঠিক ছিল না।
রাহেলার চোখে পানি এসে গেছে। সে চোখ মুছতে মুছতে বলল, তোমার কি ধারণা তুমি আমেরিকা যাচ্ছ শুনে আমি ঘ্যানঘ্যান শুরু করব–আমাকে সঙ্গে নিয়ে চল? ভুল কথা ভেবেই ভাইজান। আমি স্বামীর সংসারে ঝি-গিরি করার ভাগ্য নিয়ে এসেছি। আমি তোমার সঙ্গে প্লেনে উঠব এরকম কল্পনাও আমার নেই।
শামসুদ্দিন হতাশ গলায় বললেন, তুই শুধু শুধু আমার সঙ্গে রাগ করছিস।
রাহেলা কঠিন গলায় বলল, তুমি ভুল বলছ ভাইজান। আমি তোমার উপর রাগ করব কেন? তুমি কে? তুমি আমার কেউ না–শুধু দূরসম্পর্কের বড় ভাই। বোনের বিয়ে হবার পর আপন ভাই আর অই থাকে না, বাইরের মানুষ হয়ে যায়। তুমি অনেক দুরের ভাই। বাইরের একজন মানুষ।
আমি বাইরের মানুষ?
অবশ্যই বাইরের মানুষ। পনের শ টাকা খরচ দিয়ে খাও দাও ঘুমাও। আমার সংসার কীভাবে চলছে তুমি কিছু জানো? না, জানো না।
তুই খারাপ অবস্থায় আছিস এটা জানব না কেন? রফিকের ব্যবসাপাতি খারাপ যাচ্ছে, সবই জানি।
ভাইজান, তুমি কিছুই জানো না। তোমার জানার দরকারও নাই। বাসায় একটা রঙিন টেলিভিশন ছিল। নষ্ট হয়ে গেছে, ওয়ার্কশপে সারাতে দেয়া হয়েছে। এটা তুমি জাননা, তাই না?
হুঁ।
তুমি আসল ঘটনা জানো না। রঙিন টিভি নষ্ট হয় নাই। সারাতেও দেয়া হয় নাই। বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। আগে তো পেটে ভাত, তারপরে না রঙিন টিভি।
বলিস কী?
এতেই চমকে উঠলে! আরো ঘটনা শুনবে? আচ্ছা বেশ, শোন। বলতে যখন বসেছি সবই বলব। রাখ ঢাক করব না। তোমাকে লজ্জাও করব না। তুমি কে? তুমি কেউ না। তুমি বাইরের একজন পেয়িং গেস্ট। নিজের ভাই হলে তোমাকে লজ্জা করার কথা আসত।
শামসুদ্দিন হতাশ গলায় বললেন, রাহেলা তুই খুবই উত্তেজিত। এই সময় উত্তেজনা ভালো না। আরেকদিন সব শুনব?
রাহেলা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তোমাকে আজই শুনতে হবে। আজ বলতে না পারলে আমি আর কোনো দিনই বলতে পারব না। পৃথুর বাবার সম্পর্কে কথা।
কী কথা?
গত মাসের নয় তারিখ বিষ্যুদবার রাত তিনটার সময় আমার ঘুম ভেঙে গেছে। দেখি বিছানায় পৃথুর বাবা নাই। তার খোঁজে বিছানা থেকে নামলাম, কোথাও সে নাই। তারপর তাকে কোথায় পেলাম জানো? বুয়ার ঘরে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ।
শামসুদ্দিন হতভম্ব গলায় বললেন, সে-কী!
রাহেলা চোখ মুছতে মুছতে বলল, আমি তারপরেও এই বাসায় পড়ে আছি। কারণ আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নাই। আমার মা নাই, বাবা নাই। আমার এক খালাতো ভাই আছে। তারও কোনো মেরুদণ্ড নাই। সে থাকে আমার সাথে। তার মনে মনে ভালো ভালো চিন্তা। সে আমেরিকা যাবে। হাফপ্যান্ট পরা মেমসাহেব দেখবে। মেম সাহেবদের সাদা সাদা পা দেখে তার ফুর্তি হবে।
রাহেলা আমার কথা শোন…।
তোমার তো কোনো কথা নাই ভাইজান। তোমার কথা আমি কী শুনব? তুমি আমার কথা শুনবে। পৃথুর বাবার লজ্জা তো ভেঙে গেছে, এখন কী করে জানো? প্রায় রাতেই বুয়ার ঘরে যায়। আমাকে বলে দিয়েছে এই নিয়ে যদি কোনো কথা বলি তাহলে বাসা থেকে বের করে দিবে। বাসা থেকে বের করে দিলে আমি যাব কোথায়?
দরজায় কলিং বেল বাজছে। রফিক এসেছে। রাহেলা চোখ মুছে উঠে গেল। শামসুদ্দিন ভেবেই পেলেন না রফিকের মতো ভালো একটা ছেলে এমন জঘন্য কাজ কীভাবে করে। রাহেলা ভুল করছে না তো? মেয়েরা এমনিতেই সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত হয়। পেটে সন্তান থাকা অবস্থায় সন্দেহ রোগ অনেকগুণে বেড়ে যায়। হয়তো রফিকের রাতে পানির পিপাসা পেয়েছে। পানি খাবার জন্য সে গিয়েছে রান্না ঘরে আর তাতেই যা ভাবার না রাহেলা তাই ভেবে বসে আছে। কাইক্যা মাছকে ভেবেছে কুমির। রাহেলা যা বলছে তা হতেই পারে না। রফিক এরকম ছেলেই না। তা ছাড়া যে বয়াকে নিয়ে কথা হচ্ছে তাকে নিয়ে কোনো কিছুর ভাবারই অবকাশ নেই। কালো, ঠোঁট, মোটা, মধ্যবয়স্ক মহিলা। মুখ ভর্তি বসন্তের দাগের মতো দাগ।