জয়নালের হতাশ মুখের দিকে তাকিয়ে শামসুদ্দিন সাহেবের মনটা খারাপ হয়ে গেল। নিয়ম থাকলে তিনি অবশ্যই তার পাসপোর্টটা ছেলেটার হাতে দিয়ে দিতেন এবং আনন্দের সঙ্গে বলতেন–যাও, আমেরিকায় যাও।
শামসুদ্দিন টিভির সামনে বসে আছেন। টিভিতে সিসেমিস স্ট্রিট নামে শিক্ষামূলক কী একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। বকের মতো পোশাক পরা একটা লোক টেনে টেনে কথা বলছে। দেখতে ভালো লাগে না আবার খারাপও লাগে না। তার ঝিমুনির মতো এসে গেল। কখন ঘুমিয়ে পড়লেন নিজেও জানেন না। ঘুমের মধ্যে লম্বা চওড়া এক স্বপ্নও দেখে ফেললেন। স্বপ্নে নৌকায় করে নানার বাড়ি যাচ্ছেন। নৌকার মাঝি দেখতে সিসেমিস স্ট্রিটের বকের মতো। নৌকা চালাবার ফাঁকে ফাঁকে সে তার লম্বা ঠোঁটটা দিয়ে শামসুদ্দিনের পেটে খোঁচা দিয়ে দিয়ে বলছে- ও চৈতার বাপ। ঘুমাও কেন? নদীর দুই ধারে সুন্দর সুন্দর সিনারি। সিনারি দেখ। ও চৈতার বাপ।
চৈতার বাপ তার শৈশবের একটা নাম। এই নামে তার বাবা তাকে ডাকতেন। এই অদ্ভুত নামটা তিনি তাঁর নিজের ছেলেকে কেন দিয়েছিলেন শামসুদ্দিন সেটা জানেন না। তার ডাক নামটা খুবই অদ্ভুত এটা বোঝার আগেই তার বাবা মারা গেলেন। অদ্ভুত নামের রহস্য আর জানা হলো না। নামটা শামসুদ্দিন সাহেব নিজেও ভুলে গিয়েছিলেন। প্রায় পঞ্চাশ বছর পর আমেরিকান এম্বেসির ভিসাপ্রার্থীর ওয়েটিং রুমে ছেলেবেলার নামটা ঘুমের মধ্যে মনে পড়ল।
বকের মতো মাঝিটা বড় বিরক্ত করছে। ক্রমাগত চৈতার বাপ চৈতার বাপ বলে গায়ে খোঁচা দিচ্ছে। শামসুদ্দিন বিরক্ত হয়ে চোখ মেলে দেখলেন জয়নাল তার গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে। জয়নালের চোখ ভেজা। তার হাত-পা কাপছে। তিনি লক্ষ করলেন তাদের ঘিরে কিছু লোকজন দাড়িয়ে আছে।
শামসুদ্দিন দুঃখিত গলায় বললেন, ভিসা হয় নি?
জয়নাল জবাব দিল না। তার মুখ স্বাভাবিক করুণ দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে ছেলেটা এখনই কেঁদে ফেলবে।
ঐ মেয়েটার ঘরে ডাক পড়েছিল? তিন নম্বর ঘর?
জি।
কী বলে ছেলেটাকে সান্ত্বনা দেবেন শামসুদ্দিন বুঝতে পারছেন না। সান্ত্বনার দুএকটা কথা বলতে ইচ্ছা করছে। জয়নাল উদাস গলায় বলল, চলুন বের হই।
চল। বেশি মন খারাপ করো না।
জয়নাল বলল, আপনি কি এখনই বাসায় চলে যাবেন? পাঁচটা মিনিট আমার সঙ্গে থাকেন। এক কাপ চা খান। চায়ের পয়সা আমি দিব।
বেশতো চুল।
দূর্গের ভেতর থেকে তারা বের হয়েছেন। ছেলেটা মাথা নিচু করে হাঁটছে। একবার সার্টের হাতায় চোখ মুছল। শামসুদ্দিনের মনটা অস্বাভাবিক খারাপ হয়ে গেল। তিনি ছেলেটার পিঠে হাত রাখলেন।
জয়নাল বলল, আপনি কোথায় থাকেন ঠিকানাটা বলুন। আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখব। ইনশাল্লাহ দুইজন একসঙ্গেই আমেরিকা যাব। আপনি খুবই নরম লোক–আপনাকে গাইড না করলে বিরাট বিপদে পড়বেন।
শামসুদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, ভিসা ছাড়া তুমি আমেরিকা যাবে কীভাবে?
জয়নাল লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, চাচা মিয়া, আমার ভিসা হয়েছে। অনেক লোকজন ছিল তো এই জন্যে কিছু বললাম না। তাদের চোখ লাগতে পারে। হয়তো কারো চোখ লেগে গেল দেখা যাবে শেষ মুহূর্তে কিছু একটা হয়েছে। পাসপোর্টে সিল পড়ে নাই।
ঐ মেয়ে তোমাকে ভিসা দিয়েছে?
জি। কিছুই জিজ্ঞেস করে নাই। একবার শুধু মুখের দিকে তাকাল। খসখস করে একটা কাগজে কী ফেন লিখল। তারপর বলল, তিনটার সময় এসে পাসপোর্ট নিয়ে যেও।
জয়নালের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। অথচ মুখটা হাসি হাসি। নান্দাইল হাই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক শামসুদ্দিন সাহেবের মনে হলো তিনি তাঁর দীর্ঘ জীবনে যে অল্প কটি অসাধারণ দৃশ্য দেখেছেন এটি তার একটি। তার নিজের চোখেও পানি এসে গেল।
কৈ মাছের তরকারিটা
কৈ মাছের তরকারিটা খেতে এত ভালো হয়েছে।
মনে হলো গত দশ বছরে তিনি এমন রান্না খান নি। ছোট ছোট আলু দিয়ে রান্না। ধনেপাতার হালকা গন্ধ। কাঁচা মরিচের ঝাল। ঝালটা জিভে লেগে থাকে, কখনো মিলায় না। টমেটোও দেয়া হয়েছে। টমেটো গলে যায় নি। আস্তু আছে। গলে গেলে কৈ মাছে টুক ভাব চলে আসত, সেটা আসে নি। কৈ মাছের সালুনকে অঙ্কের মতো ছাকা নাম্বার দিতে হবে। দশে দশ।
বাটিতে একটাই মাঝারি সাইজের কৈ মাছ। তার আরেকটা মাছ চাইতে ইচ্ছা করছে। অনেক কষ্টে ইচ্ছা দমন করছেন। রাহেলার বাড়িতে সব কিছু হিসাব করা।
রাহেলা তাঁর বোন।
আপন বোন না, খালাতো বোন। শামসুদ্দিনের বড় খালী হামিদা বানুর ছোট মেয়ে। শামসুদ্দিন বড় হয়েছেন হামিদা বানুর কাছে। এই মহিলার অনেকগুলি ছেলেমেয়ে, তারপরেও শামসুদ্দিনের জন্যে তার মমতার কোনো রকম ঘাটতি ছিল না। শামসুদ্দিন বোনের বাড়িতে আছেন চার বছর ধরে। অভাবি সংসার সামলাতে গিয়ে রাহেলা যে পুরোপুরি বিপর্যস্ত এটা তিনি চোখের সামনে দেখছেন কিন্তু কিছু করতে পারছেন না। মাসের দুই তারিখে তিনি রাহেলার হাতে পনেরশ টাকা দেন। রাহেলা হাত পেতে টাকা নিতে নিতে বলে–এ-কী! টাকা দিচ্ছ কেন? তুমি কি আমার বাড়িতে পেইং গেস্ট যে মাসের প্রথমেই খরচ দেবে? আমার দরকার হলে আমি তো চেয়ে নিবই। তোমার কাছ থেকে টাকা নিতে আমার কি কোনো অসুবিধা আছে?
শামসুদ্দিন জানেন সবই কথার কথা। তার পনেরশ টাকা রাহেলা সংসার খরচে ধরে রেখেছে। প্রতিটি টাকাই হিসাবের টাকা। শামসুদ্দিনের প্রায়ই ইচ্ছা করে পাঁচ দশ হাজার টাকা রাহেলার হাতে তুলে দিয়ে বলেন–নে, তুই ইচ্ছামতো খরচ কর। পছন্দ করে শাড়ি কিনে আন, স্যান্ডেল কিনে আন। বাচ্চাদের নিয়ে কোনো ভালো রেস্টুরেন্টে খেতে যা। এতগুলি টীকা এক সঙ্গে হাতে পেয়ে রাহেলা কী করে এটা তার দেখার ইচ্ছা। কাজটা করা হয় নি। তবে ভবিষ্যতে করবেন। অবশ্যই করবেন। সব মিলিয়ে ব্যাংকে তাঁর আছে তিন লক্ষ পঁচাত্তর হাজার টাকা। আমেরিকার জন্য এক লাখ টাকা ধরা আছে। তার পরেও হাতে থাকবে দুই লাখ পঁচাত্তর।