রাহেলা বলল, না। আমি বাসায় যাব।
শায়লা অবাক হয়ে বলল, এখন বাসায় যাবি মানে কী? রাত একটা বাজে।
বাজুক রাত একটা। আমার এখানে থাকতে ভালো লাগছে না। আমার শরীর খারাপ লাগছে। বুক ধড়ফড় করছে।
এত রাতে বাসায় যাবি কীভাবে?
তুই তো গাড়ি চালাতে পারিস। তুই আমাকে গাড়ি করে নামিয়ে দিবি। আর তা যদি না পারিস- দারোয়ান পাঠিয়ে রিকশা বা বেবিটেক্সি কিছু একটা এনে দে। আমি একা চলে যাব।
একী চলে যাবি?
হুঁ।
শায়লা বলল, তোর তো মাথা খারাপ। কোনো ভালো সাইকিয়াট্রিস্টকে দিয়ে তোর চিকিৎসা করানো উচিত।
রাহেলা বলল, চিকিৎসা করবি। এই মুহূর্তে তো আর চিকিৎসা করানো যাচ্ছে না। এখন আমি বাসায় যাব।
রাহেলা সোফা থেকে উঠে দাড়াল। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে একাই দরজা খুলে বের হয়ে যাবে। শায়লা বিরক্ত গলায় বলল, দাড়া গাড়ি বের করছি। তোকে আমার দোহাই লাগে, আবার যদি তোদের মধ্যে রাগারাগি হয় আমাদের বাসায় আসবি না।
রাত দুটা বাজে।
হাসপাতালের বারান্দার রেলিং-এ হেলান দিয়ে জয়নাল দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে সিগারেট। হাসপাতালে সিগারেট খাওয়া নিষেধ। রাত বারটার পর সব নিষেধই খানিকটা দুর্বল হয়ে যায় এই ভরসায় জয়নাল সিগারেট ধরিয়েছে। সাধারণত খালি পেটে সিগারেটে টান দিলে গা গুলায়। আজ গা গুলাচ্ছে না। বরং ভালো লাগছে। ঠাণ্ডা বাতাস ছেড়েছে। বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। একটা পাটি থাকলে মেঝেতে পার্টি পেতে ঘুমিয়ে পড়ত।
জয়নালের মন অস্বাভাবিক ভালো। শামসুদ্দিন সাহেব এখন চোখ মেলে তাকাচ্ছেন। কথাবার্তা বলছেন। তাঁর প্রেসার নেমে প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ডাক্তার বলছেন, ভয়ের কিছু নেই। রোগীর যা দরকার তা হলো–রেস্ট। হাসপাতালেও রোগী রাখার দরকার নেই। সকালবেলা বাড়িতে নিয়ে গেলেই হবে। জয়নাল ঠিক করেছে রাতটা হাসপাতালের বারান্দায় পার করে দিয়ে ভোরবেলা রোগী রিলিজ করে বাসায় ফিরবে। সার্বক্ষণিকভাবে সে নিজেই রোগী দেখবে। ইতি তো আছেই। যতই দিন যাচ্ছে ইতি মেয়েটাকে তুরি ততই পছন্দ হচ্ছে। এক সময় তার ধারণা ছিল ইতি চ্যাং ব্যাঙ টাইপ মেয়ে। এখন সে ধারণা পাল্টে গেছে। চ্যাং ব্যাঙ টাইপ মেয়ে অপরিচিত একজন অসুস্থ মানুষ নিয়ে এত ঝামেলা করে না। ইতি করেছে। এখন সে গিয়েছে চায়ের খোঁজে। রাত দুটার সময় চা পাওয়ার কথা না। তবে ইতি যেমন স্মার্ট মেয়ে ব্যবস্থা করবেই।
করিডোরের মাথায় ইতিকে দেখা গেল। তার হাতে লাল রঙের ছোট্ট ফ্লাস্ক? আরেক হাতে কাগজের ঠোঙ্গা। নিশ্চয়ই খাবারদাবার আছে। জয়নালের মন সামান্য খারাপ হয়ে গেল। নাশতা খেয়ে চা খাবার পর একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা করবে। জয়নালের সঙ্গে সিগারেট নেই। শেষ সিগারেটটা সে একটু আগে শেষ করেছে।
ইতি প্যাকেট ভর্তি গরম সিঙাড়া এনেছে, কল এনেছে। এক রোগীর কাছ থেকে ফ্লাস্ক ধার করে ফ্লাস্ক ভর্তি চা এনেছে। ছোট্ট কাগজের পকেটে দুটা মিষ্টি পান। তারচেয়েও বিস্ময়কর ঘটনা হলো–ইতি এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট এবং একটা দেয়াশলাইও এনেছে। জয়নাল সিঙাড়ায় কামড় দিতে দিতে স্বাভাবিক গলায় বলল, সিগারেট কী মনে করে এনেছ? ইতি বলল, টেনশনে পড়ে তুমি যে হারে সিগারেট টানছু আমার ধারণা তোমার সিগারেট শেষ। চায়ের সঙ্গে তুমি আরাম করে সিগারেট খাও। যদি সিগারেট না থাকে এই ভেবে কিনেছি।
জয়নাল ফ্লাস্ক থেকে চা ঢালতে ঢালতে বলল, আগামী দশ বছরে তুমি যে সব অপরাধ করবে তার প্রতিটি আমি অ্যাডভান্স ক্ষমা করে দিলাম।
ইতি হাসতে হাসতে বলল–তুমি মহান, তুমি একুশে ফেব্রুয়ারি।
জয়নাল বলল, চাচাজির লেটেস্ট খবর কিছু জানো?
ইতি বলল, জানি। উনি ভালো আছেন। আরাম করে ঘুমোচ্ছেন। উনার বোন এসেছেন। তিনি ভাইয়ের হাত ধরে বসে আছেন। বসার ভঙ্গিটা একবার আড়াল থেকে দেখে আসি। দেখলে ভালো লাগবে।
ভালো লাগবে কেন?
ইতি মুগ্ধ গলায় বলল, ভাইয়ের হাত ধরে উনি এমন কঠিন ভঙ্গিতে বসে আছেন যে দেখলেই মনে হবে–তার ভাইকে তার হাত থেকে নিয়ে যাবার ক্ষমতা কারো নেই। আজরাইলেরও নেই। আজরাইলকেও দরজার বাইরে থমকে দাড়াতে হবে।
জয়নাল আগ্রহের সঙ্গে বলল, চল তো দেখে আসি।
কিছুক্ষণ আগেই শামসুদ্দিন সাহেবের ঘুম ভেঙেছে। তিনি অবাক হয়ে রাহেলার দিকে তাকাচ্ছেন। একটু আগে ইতি যে চেয়ারটায় বসে ছিল এখন সেখানে অন্য একজন বসে আছে। যে বসে আছে সে দেখতে রাহেলার মতো, কিন্তু রাহেলা না। শামসুদ্দিন বললেন, কে?
মেয়েটা তার কাছে ঝুঁকে এসে বলল, ভাইজান আমি রাহেলা।
তোর রাগ কমেছে?
রাহেলা বলল, হ্যাঁ কমেছে।
রফিক কোথায়?
ও পৃথুকে নিয়ে বাইরে বারান্দায় বসে আছে। ডাকব?
ডাকতে হবে না। তোরা খামাখা কষ্ট করিস না তো। বাসায় গিয়ে আরাম করে ঘুমো। আমি ভালো আছি। সকালে আমাকে রিলিজ করে দেবে।
রাহেলা বলল, ভাইজান, তুমি মোটেও ভালো নেই। এই যে আমি তোমার বিছানার পাশের চেয়ারে বসেছি–তুমি পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমি চেয়ার থেকে উঠব না।
শামসুদ্দিন হেসে ফেললেন। রাহেলা বলল, ভাইজান, হেসো না। আমি কোনো হাসির কথা বলি নি।
শামসুদ্দিন বললেন, আচ্ছা যা, হাসব না।
রাহেলা চাপা গলায় বলল, তুমি আরাম করে ঘুমাও ভাইজান। তুমি আরাম করে ঘুমাও। আমি তোমার পাশ থেকে এক সেকেন্ডের জন্যেও নড়ব না।
শামসুদ্দিন ঘুমিয়ে পড়লেন।