আমি টিভি দেখব।
একা একা ভয় পাবে না তো?
না।
তুমি থাক, সেটাই ভালো। বাড়িওয়ালার বাসায় তোমার মা টেলিফোন করতে পারেন। তোমাকে খবর দিলেই তুমি টেলিফোন ধরবে।
আচ্ছা।
টেলিফোনে কী বলবে শুনে রাখ। তুমি বলৰে যে তোমার বড় মামা খুবই অসুস্থ। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তোমার মা যেন এক্ষুণি চলে আসে।
আচ্ছা।
আমি বেশি দেরি করব না। যাব আর সিগারেট নিয়ে চলে আসব।
আচ্ছা।
রফিক সিগারেট কিনতে বের হলো। টেনশনের সময় ঘনঘন সিগারেট টানতে ইচ্ছা করে। দুঘণ্টার উপর হয়ে গেছে সিগারেট খাওয়া হচ্ছে না। যেকোনো মুহূর্তে রাহেলা টেলিফোন করতে পারে এই ভেবে সে যায় নি। টেলিফোন এখনো আসে নি। রাগ করে বাড়িঘর ছেড়ে চলে যাওয়া রাহেলার জন্যে কোনো নতুন ব্যাপার না। তবে যতবারই সে বাইরে গিয়েছে রাত দশটার আগে ফিরে এসেছে। তার যাবার জায়গাও সীমিত। যে সব জায়গায় তার যাবার সম্ভাবনা তার প্রতিটি রফিক খুঁজে এসেছে। রাহেলা নেই।
রফিক কী করবে বুঝতে পারছে না। শামসুদ্দিন সাহেব হাসপাতালে পড়ে আছেন। রফিকের উচিত তার পাশে থাকা। চিকিৎসার কী হচ্ছে না হচ্ছে তার খোঁজ নেয়া। অথচ সে পৃথুর সঙ্গে টিভি সেটের সামনে। জয়নাল নামের নিতান্তই অপরিচিত একজন মানুষ দৌড়াদৌড়ি ছোটাছুটি করছে। জয়নাল সম্পর্কে আগে যা ভাবা হয়েছিল তা ঠিক না। মানুষটা অবশ্যই ভালো।
রাহেলা টেলিফোন করল রাত বারটায়। বাড়িওয়ালার ছেলে খুবই বিরক্তমুখে খবর দিতে এলো। এত বিরক্ত হবার মতো কিছু ঘটে নি। ইমার্জেন্সি সিচুয়েশন তৈরি হতেই পারে। ভয়ঙ্কর কোনো বিপদে রাত বারটার সময় ভাড়াটের টেলিফোন আসতেই পারে।
রফিক মাথা ঠাণ্ডা রেখে টেলিফোন ধরল। সে ঠিক করে রাখল রাহেলার সঙ্গে খুব শান্ত গলায় কথা বলবে। কোনোরকম রাগারাগি করবে না। ভুলিয়ে ভালিয়ে তাকে বাসায় নিয়ে আসতে হবে।
টেলিফোন ধরতেই রাহেলা বলল, হ্যালো শোন, আমি নেত্রকোনা যাচ্ছি। কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে টেলিফোন করছি।
নেত্রকোনা যাচ্ছি মানে কী? নেত্রকোনার কোথায় যাচ্ছ?
বাবার বাড়িতে যাচ্ছি। না-কি বাবার বাড়িতেও যেতে পারব না? বাবার বাড়িতে যেতে হলেও তোমার কাছ থেকে ভিসা নিতে হবে?
রাহেলা আমার কথা একটা কথা শোন…
রফিকের কথার মাঝখানে রাহেলা চেঁচিয়ে বলল, তোমার কোনো কথা শুনব নী। এখন থেকে আমি কথা বলব, তুমি শুনবে। তোমার সঙ্গে আমার সমস্ত সম্পর্কের এখানেই ইতি। তুমি যদি আমাকে আনতে যাও তাহলে গুণ্ডা দিয়ে তোমাকে জুতা পেটা করব। চরিত্রহীন বদ কোথাকার!
রাহেলী শোন, বাসায়…
আবার কথা বলে! খবরদার কথা বলবি না। খবরদার।
রাহেলা খট করে টেলিফোন লাইন কেটে দিল।
রাহেলার খুব মজা লাগছে। পৃথুর বাবা এখন চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হোক। ছোটাছুটি করতে থাকুক। রাহেলা নিশ্চিত পৃথুর বাবা কমলাপুর রেলস্টেশনে চলে যাবে। স্টেশনের এ-মাথা ও-মাথা তাকে খুঁজবে। তার মাথায় সপ্ত আকাশ ভেঙে পড়বে। পক আকাশ ভেঙে। শিক্ষা হোক। রাহেলার সবাইকে শিক্ষা দিতে ইচ্ছা করছে। কঠিন শিক্ষা। যে-ই তার কাছে আসবে সে-ই শিক্ষা পাবে। সে-ই বুঝবে কত ধানে কত চাল।
সমস্যা হচ্ছে পৃথুর বাবা মানুষটা ভালো। শুধু ভালো না, বেশ ভালো। তারপরেও রাহেলা তাকে শিক্ষা দেবে। সে সুখে নেই, অন্যরা কেন সুখে থাকবে? তার গায়ে আগুন জ্বলছে, অন্যদের গায়ে কেন জ্বলবে না? অন্যদের গায়ে কেন ঠাণ্ডা বৃষ্টির ফোটা পড়বে?
রাহেলা খুব ঘামছে। সে বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। তার মন এখন খুবই ভালো, কিন্তু শরীর ভালো লাগছে না। রাহেলা এসে উঠেছে তার কলেজ জীবনের বান্ধবী শায়লার বাসায়। রাহেলা কলেজ পাশ করতে পারে নি, তার আগেই বিয়ে হয়ে গেল। শায়লা ঠিকই কলেজ পাশ করেছে–মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে ডাক্তার হয়েছে। কোনো এক ক্লিনিকে ডাক্তারি করে। মাসে কুড়ি হাজার টাকা পায়। অথচ এই মেয়ে কলেজে হাবাগোবা ছিল। তাকে সবাই ডাকত হাবলি বেগম। হাবা থেকে বলি। সেই হাবলি মাসে কুড়ি হাজার টাকা পায়। স্বামী চাকরি করে। একটা মাত্র বাচ্চা। বাড়ি ভর্তি জিনিসপত্র। এর মধ্যে একটা হলো মাইক্রোওয়েভ ওভেন। বোতাম টিপলেই ঠাণ্ডা খাবার গরম হয়ে যায়। হাবলিটা কত সুখে আছে, আর তার কী অবস্থা!
রাহেলা সোফায় বসে হাঁপাচ্ছে। শায়লী বলল, তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?
রাহেলা না-সূচক মাথা নাড়ল।
শায়লা বলল, কার সঙ্গে কথা বলছিলি?
পৃথুর বাবার সঙ্গে।
কঠিন রাগারাগি চলছে?
রাহেলা বলল, হ্যাঁ।
শায়লা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে রাগরাগি ইওয়া ভালো। যত বেশি রাগারাগি হবে তাদের ভেতরের বন্ধন তত শক্ত হবে।
এটা কি তোর ডাক্তারি কথা?
ডাক্তারি কথা না, এটা আমার মনের কথা। আমি যখনই কোনো স্বামী-স্ত্রীকে ঝগড়া করতে দেখি আমার হিংসা হয়। ভালোবাসা আছে বলেই ঝগড়া হচ্ছে। আমার অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের কখনোই কোনো রাগারাগি হয় না। সে সারাদিন তার মতো অফিস করে। আমি ক্লিনিকে থাকি। রাতে এক সঙ্গে ডিনার খাই। টুকটাক গল্প করি। কিছুক্ষণ টিভি দেখে দুজনে দুটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমুতে যাই। আবার সকালবেলা দুজন দুদিকে চলে যাই। তোদের ঝগড়া কী নিয়ে হয়?
সবকিছু নিয়েই হয়।
শায়লা মুগ্ধ গলায় বলল, কী রোমান্টিক! তুই রাগ করে বাসা থেকে চলে এসেছিস মিথ্যা করে বললি তুই আছিস কমলাপুর রেলস্টেশনে। সেই বেচারা তোকে স্টেশনে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ভাবতেই ভালো লাগছে। তুই চা-কফি কিছু খাবি?