ভালো।
আপনি কোনো দুশ্চিন্তা করবেন না। শরীর থেকে অনেক রক্ত গেছে তো, এই জন্য আপনি দুর্বল হয়ে পড়েছেন। আপনাকে তিন ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়েছে। আরো রক্ত দেয়া হবে।
শামসুদ্দিন ক্লান্ত গলায় বললেন, আচ্ছা।
চাচাজি, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না। বলুন তো আমি কে?
শামসুদ্দিন অস্পষ্ট গলায় বললেন, তুমি বীথি।
জি না চাচাজি, আমার নাম ইতি। আমি জয়নালের স্ত্রী। আমাদের বিয়ের সময় আপনি ছিলেন। আপনি ছেলে পক্ষের উকিল। এখন মনে পড়ছে?
হ্যাঁ। জয়নাল কোথায়?
ও আপনাকে নিয়েই ছোটাছুটি করছে। চলে আসবে।
শামসুদ্দিন অস্পষ্ট গলায় বললেন, আমি তোমাকে চিনতে পারি নি। তুমি কিছু মনে করো না। আমি খুবই লজ্জিত।
ইতি বলল, কী আশ্চর্য কথা! আমি কিছু মনে করব কেন? আপনার উপর দিয়ে যে ঝড় গিয়েছে আপনার তো কিছুই মনে থাকার কথা না। চাচাজি, আমি আপনার গায়ে হাত বুলিয়ে দেই?
দরকার নাই।
না বলার পরও ইতি হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটার হাতে ভালো মায়া আছে। শামসুদ্দিনের চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে শরীরে আরামদায়ক আলস্য।
ইতি বলল, চাচাজি আপনি খুব তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠুন। তারপর জয়নালকে নিয়ে আমেরিকা চলে যান। সেখানে অবশ্যই আপনি বড় ডাক্তার দেখাবেন।
শামসুদ্দিন বললেন, আমি একটু পানি খাব।
ইতি চামচে করে পানি শামসুদ্দিন সাহেবের মুখে দিচ্ছে। তিনি আগ্রহ করে পানি খাচ্ছেন। তার কাছে মনে হচ্ছে ঠিক এই ভাবে অনেককাল আগে কেউ একজন তাকে চামচে কবে পানি খাইয়েছে। সেই একজনটা কে তার মনে পড়ছে না। সেই জন্যে খুব অস্বস্তি লাগছে। অস্বস্তিটা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। তাঁর মনে হচ্ছে নামটা মনে না পড়লে অস্বস্তিটা এক সময় খুবই বেড়ে যাবে। তার হাঁচি আবারো শুরু হয়ে যাবে।
পানি আর খাব না।
ইতি পানির গ্লাসটা টেবিলে রাখতে গেল। তখন শামসুদ্দিন সাহেব অবাক হয়ে দেখলেন, যে চেয়ারটায় ইতি বসেছিল সেই চেয়ারে বৃদ্ধ একজন মানুষ পা গুটিয়ে বসে আছেন। তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ইতির দিকে। সেই বৃদ্ধ মানুষটা আর কেউ না, তার বাবা।
শামসুদ্দিনের মনে হলো তিনি মারা যাচ্ছেন। মৃত্যুর আগে আগে মানুষ তার মৃত আত্মীয় স্বজনকে দেখে। তিনিও তাই দেখছেন। চেয়ারে বসা বৃদ্ধ ঝুঁকে এসে বলল, ও চৈতার বাপ, এই সুন্দরমতো মেয়েটা কে?
শামসুদ্দিন বললেন, এর নাম ইতি। জয়নালের বউ।
কোন জয়নাল? সিরাজদিয়ার জয়নাল?
বাবা, সিরাজদিয়ার জয়নাল চাচা না। আপনি তাকে চিনবেন না।
তোর শরীরটা তো দেখি ভালো না।
আমার শরীর খুবই খারাপ।
আমার নিজেরও শরীর খারাপ। পায়ে ব্যথা। গরম সেঁক দিতে পারলে হতো। যেখানে থাকি সেখানে গরম সেঁক দেয়ার কোনো ব্যবস্থা নাই।
আপনি থাকেন কোথায়?
চিপাচাপায় পড়ে থাকি। মানুষকে ঠিকানা দিতেও ভয় লাগে। আচ্ছা তোকে একদিন নিয়ে যাব। তোর শরীরটা সারুক তারপর নিয়ে যাব। হাঁটাপথে যেতে হয়। হাঁটতে হাঁটতে অবস্থা কাহিল। রাস্তাও ভালো না। পথে পথে কংকর।
শামসুদ্দিন চোখ বন্ধ করে ফেললেন। তার চারপাশে কী হচ্ছে তিনি কিছু বুঝতে পারছেন না। তাকে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। এই ঘুমের মানেই কি মৃত্যু? ঘুম আর ভাঙবে না। সত্যি সত্যি যদি তাঁর মৃত্যু হয় তাহলে তো ইতিকে কিছু কথা বলা দরকার। যেমন তিনি ঠিক করে রেখেছেন জয়নালের আমেরিকা যাবার টিকিটের টাকাটা তিনি দেবেন। বেচারা অনেক ছোটাছুটি করেও টিকিটের টাকা জোগাড় করতে পারছে না। সে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে। বেচারাকে দুশ্চিন্তামুক্ত করা দরকার।
ইতি!
জি চাচাজি?
একটু দেখ তো–চেয়ারে কি কেউ বসে আছে?
ইতি বিস্মিত হয়ে বলল, না তো।
আচ্ছা ঠিক আছে।
ইতি বলল, আপনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন। আমি একজন ডাক্তার ডেকে আনি।
ডাক্তার ভাকতে হবে না। কয়টা বাজে?
দশটা পঁচিশ।
ইতি ডাক্তার ডাকতে গেল। ঠিক তখনই শামসুদ্দিন হাঁচি দিলেন। চেয়ারে বসে থাকা বৃদ্ধ মানুষটি বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। শামসুদ্দিন আবারো হাঁচি দিলেন। বৃদ্ধ বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। বৃদ্ধের মুখ হাসি হাসি। মনে হচ্ছে বৃদ্ধ খুব মজা পাচ্ছে।
রাত এগারোটা বাজে।
রফিকের মেজাজ ভয়ঙ্কর খারাপ। মেজাজ সামলানোর চেষ্টা করছে। সামলাতে পারছে না। সে পৃথুর সঙ্গে বসে আছে। তার দৃষ্টিও ছেলের মতোই টেলিভিশন সেটের দিকে। টেলিভিশনে কিছু একটা হচ্ছে, কী হচ্ছে বুঝতে পারছে না। মাঝে মাঝে পৃথু খিলখিল করে হেসে উঠছে, তখন সে তাকাচ্ছে পৃথুর দিকে। সেই দৃষ্টিতে কোনো মমতা নেই।
পৃথু বলল, বাবা, মা কখন আসবে?
রফিক বলল, জানি না।
রাতে ফিরবে?
সেটাও জানি না।
রাতে আমরা ভাত খাব না বাবা?
তোমার মার জন্যে আরো আধঘণ্টা অপেক্ষা করব। এর মধ্যে সে যদি না ফিরে তাহলে হোটেল থেকে খাবার নিয়ে আসব।
বড় মামাকে খাবার দিয়ে আসতে হবে না?
তাও জানি না।
বড় মামা কি মারা যাবে বাবা?
মারা যাবে কেন? উদ্ভট ধরনের কথা বলবে না।
উদ্ভট ধরনের কথা কাকে বলে বাবা?
জানি না কাকে বলে। প্লিজ চুপ করে থাক।
মা যতক্ষণ না আসে ততক্ষণ কি আমি টিভি দেখতে পারব?
হ্যাঁ, পারবে।
মা যদি রাতে না ফিরে তাহলে কাল আমাকে স্কুলে যেতে হবে না, তাই না বাবা?
পৃথু, আর কোনো কথা শুনতে চাই না।
আচ্ছা আর কথা বলব না।
পৃথু শোন, আমার সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। আমি দোকানে সিগারেট কিনতে যাব। তুমি কি যাবে আমার সঙ্গে? না-কি টিভি দেখবে?