শামসুদ্দিনের পিছনে পিছনে লজ্জিত ভঙ্গিতে বীথি ছাদে উঠছে। হঠাৎ সিঁড়িতে শামসুদ্দিনের পা পিছলে গেল। তিনি হুড়মুড়িয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছেন, তখন বীথি চট করে তাকে ধরে ফেলল। শামসুদ্দিন খুবই লজ্জা পাচ্ছিলেন। বীথি তখন তার দিকে তাকিয়ে কোমল ভঙ্গিতে হাসল। হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিল আপনি কেন শুধু শুধু লজ্জা পাচ্ছেন? লজ্জা পাবার মতো কিছু হয় নি।
ছাদে তাদের কোনো কথা হয় নি। রেলিং ধরে দুজন অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর শামসুদ্দিন বললেন, আমার খুব অদ্ভুত একটা ডাক নাম আছে। চৈতার বাপ। অদ্ভুত না?
বীথি হাসিমুখে হা-সূচক মাথা নাড়ল। শামসুদ্দিন ভেবেছিলেন, বীথি কোনো কথাই বলবে না। অথচ বীথি তাকে চমকে দিয়ে বলল, আমার কোনো ডাক নাম নাই। আমার ভালো নাম ডাক নাম দুটাই বীথি।
শামসুদ্দিন তখন ছোট্ট একটা রসিকতা করলেন। বীথির দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার ডাক নাম যদি চৈতার বাপ হয় তাহলে তোমার ডাক নাম চৈতার মা।
বীথি শব্দ করে হেসে ফেলল। শামসুদ্দিনের সেই হাসি শুনে কেমন যেন লাগল। মনে হলো সমস্ত শরীর দুলে দুলে উঠছে। চোখের সামনেও স্ব কেমন যেন অস্পষ্ট হয়ে গেল। তিনি হঠাৎ গাঢ় স্বরে বললেন, বীথি শোন, আমি খুব দুঃখ-কষ্টে বড় হয়েছি। মানুষের দুঃখ-কষ্ট আমি জানি। আমি সারা জীবন তোমাকে কখনো কোনো কষ্ট দেব না।
বীথি মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলল, মনে থাকে যেন।
এই পর্যন্তই তাদের কথাবার্তা।
বীথির সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় নি। বিয়ের আসরে তাঁকে জানানো হয়েছে মেয়ে হঠাৎ কেন জানি বলছে বিয়ে করবে না।
আমেরিকায় পঁয়ত্রিশ বছর পর বীথির সঙ্গে তাঁর দেখা হবে। তিনি বীথিকে বলবেন–আমি বলেছিলাম সারা জীবনে তোমাকে কোনো কষ্ট দেব না। বীথি, আমি আমার কথা রেখেছি। তোমাকে কোনো কষ্ট দেই নি।
শামসুদ্দিনের খুব দেখার ইচ্ছা তাঁর কথা শোনার পর বীথি ঐ দিনের মতো মুখ টিপে হাসে কি না। বীথির ছেলেমেয়েগুলিকেও তার খুব দেখার শখ। এই ছেলেমেয়েগুলি তারও হতে পারত।
পৃথু শুনল বড় মামা আবার হাঁচি দিচ্ছেন। সে সঙ্গে সঙ্গে গুনতে শুরু করল সেভেন্টি টু, সেভেন্টি থ্রি, সেভেনটি ফোর। পৃথুর বেশ ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে মামা এবার হানড্রেড করে ফেলবে। হানড্রেড মানে সেঞ্চুরি। ক্রিকেট প্লেয়াররা সেঞ্চুরি করে। তাদের তখন খুব আনন্দ হয়। কলিংবেল বাজছে। মনে হচ্ছে বাবা এসেছে। পৃথু দরজা খুলতে গেল। সে এখন পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দরজা খুলতে পারে।
না, বাবা আসে নি। জয়নাল নামের মানুষটা এসেছে। জয়নাল হাসি হাসি মুখে বলল, কেমন আছ খোকা?
জয়নাল মানুষটা ভালো। সে যতবার এ বাড়িতে আসে ততবারই পৃথুর জন্যে কিটক্যাট নিয়ে আসে। আজ মনে হয় আনে নি।
পৃথু বলল, আমি ভালো আছি। আমার বড় মামার শরীর খুব খারাপ। আপনি তাকে নিয়ে হাসপাতালে যান।
তার কী হয়েছে?
পৃথু জবাব না দিয়ে টেলিভিশন দেখতে চলে গেল। সে সামান্য দুশ্চিন্তায় পড়েছে। জয়নাল নামের এই মানুষটা অবশ্যই বড় মামাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। তাকে একা বাসায় ফেলে যাবে না। তাকেও নিয়ে যাবে। হাসপাতালে টেলিভিশন নেই। সে কী করবে? একা একা বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করবে? পৃথু খুবই দুশ্চিন্তা বোধ করছে। দুশ্চিন্তার কারণে বড় মামার হচি গুনতে ভুলে গেছে। তিনি হয়তো হানড্রেড করে ফেলেছেন অথচ হিসাবটা কেউ রাখতে পারল না। পৃথু টেলিভিশনে মন দিল। খুবই মজার একটা কার্টুন হচ্ছে। সব দুষ্ট লোক পটাপট মরে যাচ্ছে। ভালো লোকগুলি শত বিপদে পড়েও বেঁচে যাচ্ছে। পৃথু ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে ভাবল, জীবনটা কার্টুনের মতো হলো না কেন? কার্টুনের জীবনে কোনো দুঃখ নেই। শুধুই আনন্দ। এই জীবনে ভালো লোকরা কখনো মারা যায় না। বড় মামা খুব ভালো লোক। কার্টুনে বড় মামা কখনো মারা যাবেন না। নাক দিয়ে অনেক রক্ত পড়ার পরও বেঁচে থাকবেন।
শামসুদ্দিন সাহেব চোখ মেলে ধাক্কার মতো খেলেন। তার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। সবই কেমন অন্যরকম। সবই অচেনা। তিনি অপরিচিত একটা ঘরের অপরিচিত বিছানায় শুয়ে আছেন। ঝাড়বাতি জ্বলছে, কিন্তু আলো কম। সেই আলোয় সবই আবছা দেখাচ্ছে। কোনো কিছুই স্পষ্ট না। তার বিছানার পাশের চেয়ারে যে বসে আছে সে কে? বীথি? বীথি এখানে কোত্থেকে এলো? তিনি কি স্বপ্ন দেখছেন? তিনি চোখ বন্ধ করে ফেললেন। আবার চোখ খুললেন। অবশ্যই বীথি বসে আছে। তাকে তিনি একবারই দেখেছিলেন। চেহারা অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আজ সেই চেহারা মনে পড়ল। কী সুন্দর কোমল মুখ! শামসুদ্দিন সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, কেমন আছ?
বীথি সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আগ্রহের সঙ্গে বলল, চাচাজি, আপনার ঘুম ভেঙেছে?
শামসুদ্দিনের সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। এই মেয়ে বীথি না। বীথির এত অল্প বয়স হবে না। বীথি তাকে চাচাজিও ডাকবে না। তা হলে এই মেয়েটা কে? বীথি তো বটেই; সেই চোখ, সেই মুখ। গলার স্বরও সে-রকম। শামসুদ্দিন সাহেব হতাশ চোখে হালকা সবুজ রঙের শাড়ি পরা তরুণী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছেন। তার ঘুম পাচ্ছে। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। কষ্ট করে চোখ খোলা রাখতে হচ্ছে।
চাচাজি আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন? আমার নাম ইতি। আমাকে চিনেছেন?
শামসুদ্দিন ঘুম ঘুম চোখে হা-সূচক মাথা নাড়লেন। ইতি বলল, আপনাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। এখন আপনার শরীরটা কেমন লাগছে?