পুরো ব্যাপারটা কি স্বপ্নে ঘটছে? ইতির তো এখানে আসার কথা না। নাকি কোনো ঝামেলা হয়েছে? বিয়ে যেটা হয়েছিল সেটা বাতিল। কিন্তু বাতিল হলে তো সুটকেস নিয়ে কাজের মেয়ের আসার কথা না। কী ঘটছে চারদিকে!
ইতি খুব স্বাভাবিকভাবে ঘরে ঢুকে বলল, তোমাকে বলেছিলাম না, আমি এখানে থাকব। থাকতে এসেছি।
জয়নাল বলল, ও।
ইতি বলল, তোমার এখানে রাতে থাকতে আসব শুনে বাসায় খুব হৈচৈ হচ্ছে। বাবা ভয়ঙ্কর রাগ করেছেন। মা রাগ করেছেন। সবাই আমাকে বেহায়া ডাকছে। শুধু একজন আমাকে সাপোর্ট দিয়েছে। সেই একজন কে বলো তো? আমার দাদি। এরকম অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছ কেন?
জয়নাল বলল, তুমি যে সত্যি সত্যি এসেছ এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।
ইতি বলল, বিশ্বাস না হলে কী আর করা! বিছানা থেকে চাদরটা সরাও। বালিশের ওয়ার খোল। আমি নতুন চাদর আর বালিশের ওয়ার নিয়ে এসেছি। আচ্ছা শোন, আজ তুমি যখন মিষ্টির হাঁড়ি ভেঙে চারদিকে রসগোল্লা ছড়িয়ে দিলে তখন কে সবচে বেশি খুশি হয়েছিল জানো? আমার দাদিজান।
এতে খুশি হবার কী আছে?
বিয়ের আলাপের সময় মিষ্টির হাঁড়ি ভেঙে যাওয়া নাকি খুবই শুভ লক্ষণ। দৈএর হাঁড়ি ভাঙাও শুভ। তুমি তো মিষ্টির সঙ্গে দৈও এনেছিলে। দৈ-এর হাঁড়িটা ভাঙতে পারলে না?
ইতি খিলখিল করে হাসছে। বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে হাসির শব্দ এমন সুন্দর করে মিশে গেছে। জয়নালের মনে হলো- আকাশ, বাতাস এবং পাতালে এক সঙ্গে জলতরঙ্গ বজিছে।
আছরের নামাজ
শামসুদ্দিন সাহেব আছরের নামাজ পড়তে পারলেন না।
নামাজে দাঁড়ানোর পর থেকে তার হচি শুরু হয়ে গেল। তিনি নামাজ রেখে জায়নামাজে বসে পড়লেন। হাঁচি বন্ধ হলো না। এক সময় নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়তে লাগল। হাঁচির সময় মাঝে মাঝে রক্ত যায় কিন্তু এরকম অবস্থা কখনো হয় না। শামসুদ্দিন সাহেবের পাঞ্জাবি রক্তে লাল হয়ে গেল।
খাটের উপর পৃথু পা ঝুলিয়ে বসে আছে। সে অবাক হয়ে বড় মামার নাক দিয়ে রক্ত পড়া দেখছে। একই সঙ্গে সে হাঁচির হিসাবও রাখছে। বিড়বিড় করে বলছে, থার্টি টু, থার্টি থ্রি, থার্টি ফোর। কিছুক্ষণের মধ্যে কার্টুন ঢ্যানেলে একটা মজার কার্টন হবে। পথ এসেছিল বড় মামার সঙ্গে কার্টুন দেখবে এই পরিকল্পনা নিয়ে। এখন মনে হচ্ছে তাকে একা একাই কার্টুন দেখতে হবে। কোনো ভালো জিনিস একা দেখে আরাম নেই। কিন্তু উপায় কী! যে লোকটার নাক দিয়ে ক্রমাগত রক্ত পড়ছে তাকে সে নিশ্চয়ই কার্টুন দেখতে বলতে পারে না।
পৃথু!
জি বড় মামা।
পানি খাওয়াতে পারবি?
পৃথু খাট থেকে নামল। পানি খাওয়াতে সে অবশ্যই পারবে। ফ্রিজ খুলে পানির বোতল বের করে সেই বোতলের পানি গ্রীসে ঢেলে নিয়ে আসা। খুব সহজ কাজ। পৃথুর যেতে ইচ্ছা করছে না, কারণ সামনে থেকে গেলেই হাঁচি শুনতে গণ্ডগোল হয়ে যাবে! এখন যাচ্ছে ফিফটি থ্রি। পৃথু রান্নাঘরের দিকে রওনা হলো।
ফ্রিজ ব্রা পৃথুর জন্যে নিষেধ। মা বলেছে পৃথুকে যদি কখনো দেখা যায় সে ফ্রিজ খুলছে তাহলে তাকে কানে ধরে তিনবার উঠবোস করাবে। আজ সেই ভয় নেই–মা কোথায় যেন চলে গেছে। যাবার সময় বলে গেছে আর কোনোদিন সে এ বাড়িতে ফিরবে না। ব্যাপারটা খুবই দুঃখের কিন্তু পৃথুর খুব বেশি দুঃখ লাগছে না। বরং একটু যেন ভালো লাগছে।
পৃথু পানি এনে দেখল বড় মামা জায়নামাজের উপর শুয়ে আছেন। আঙুল দিয়ে নাক চেপে ধরে মুখে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। পৃথু বলল, পানি এনেছি মামা। শামসুদ্দিন হাতের ইশারায় জানালেন পানি খাবেন না। পৃথু টিভির সামনে চলে গেল। বড় মামার হাঁচি বন্ধ হয়েছে, এখন আর হচি গুনতে হবে না। টিভি দেখতে দেখতে হাঁচি গুনতে হলে খুব সমস্যা হতো। সব মিলিয়ে আজ বড় মামা সেভেন্টি ওয়ান হাঁচি দিয়েছেন। হানড্রেডের অনেক নিচে। এটা খুব দুঃখের ব্যাপার বড় মামা কখনো হানড্রেড করতে পারেন না।
শামসুদ্দিন অবাক হয়ে রক্তের দিকে তাকিয়ে আছেন। আশ্চর্য, এত রক্ত শরীর থেকে গেছে! হাঁচি বন্ধ হয়েছে। রক্ত পড়াও মনে হয় বন্ধ হয়েছে। জায়নামাজ থেকে উঠে রক্ত ধুয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে পারলে ভালো লাগত। তিনি অনেক চেষ্টা করেও উঠে বসতে পারলেন না। একা একা উঠা যাবে না। একজন কাউকে লাগবে যে তাকে ধরে ধরে বিছানায় নিয়ে যাবে। বাসায় পৃথু ছাড়া কেউ নেই। রাহেলা সকালবেলায় রাগারাগি করে বাসা থেকে বের হয়েছে। রফিক গেছে তাকে খুঁজে আনতে। তারা কখন ফিরবে কে জানে! যতক্ষণ না ফিরবে ততক্ষণ কি রক্তের বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে?
শামসুদ্দিন চোখ বন্ধ করলেন। মাথা দুলছে। চোখ বন্ধ করলে দুলুনিটা কম লাগে। কিছুক্ষণ ঘুমুতে পারলে হতো। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। শরীর অতিরিক্ত ক্লান্ত হলে ঘুম আসে না। কেউ একজন মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে ভালো লাগত। পৃথুকে কি ডাকবেন? না থাক, বেচারা আরাম করে টিভি দেখছে।
বীথির সঙ্গে বিয়ে হলে সে এই অবস্থা দেখলে কী করত কে জানে? নিশ্চয়ই খুব অস্থির হয়ে পড়ত। একজন মানুষের জন্যে অন্য একজন মানুষের অস্থিরতা দেখতে এত ভালো লাগে! এই অস্থিরতার নামই কি ভালোবাসা? আমি তোমাকে ভালোবাসি এই বাক্যটির মানে কি–আমি তোমার জন্যে অস্থির হয়ে থাকি? কে জানে ভালোবাসা মানে কী? তিনি কখনো কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েন নি। প্রেমে না পড়েও তিনি বীথি নামের একটি মেয়ের জন্য প্রবল অস্থিরতা বোধ করেছিলেন। বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে যাবার পর একদিন শুধু মেয়েটির সঙ্গে কথা হয়েছে। বীথির ছোট চাচি বীথিকে তার বাসায় ডেকেছিলেন, শামসুদ্দিনকেও ডেকেছিলেন। তিনি শামসুদ্দিনকে বললেন, তোমরা নিজেরা কিছুক্ষণ গল্পগুজব কর। বিয়ের আগে কিছুটা পরিচয় থাকা ভালো। যাও, ছাদে চলে যাও। আমি চা পাঠাচ্ছি।