জয়নাল মুগ্ধ চোখে শামসুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে কয়েকবার বলে ফেলেছে মারাত্মক ব্যাটিং করেছেন চাচাজি। এক ওভারে পাঁচটা ছক্কা মেরেছেন। আর দরকার নেই।
রাত আটটার ভেতর বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে গেল। বিয়ের তারিখ হয়ে গেল সামনের পঁচিশ তারিখ। দেনমোহর ঠিক হলো পাঁচ লক্ষ এক টাকা, এর মধ্যে গয়নাতে একলক্ষ টাকা উসুল। শামসুদ্দিন ইতির হাতে আংটি পরিয়ে দিতে দিতে বললেন, মাগো, অতি ভালো একটা ছেলে পেয়েছ। তোমার শাড়ির আঁচল দিয়ে ছেলেটাকে এমনভাবে ঢেকে ঢুকে রাখবে যেন বাইরের কোনো ধুলা ময়লা তার গায়ে না লাগে। দামি রত্ন, যত্ন করে রাখতে হয় গো মা।
শামসুদ্দিন সাহেবের কথা শুনে জয়নালের চোখে পানি এসে গেল। চোখের পানি আটকে রাখার সে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল। জয়নাল ঠিক করে ফেলল–তার নিজের সংসার যেদিন হবে সেদিন থেকেই এই বুড়োকে সে নিজের সংসারে এনে রাখবে। শুধু দুজনের সংসার ভালো হয় না। সংসারে মুরুব্বিদের কেউ থাকতে হয়।
বিয়ের আলাপ-আলোচনার শেষে সবাই চা খাচ্ছে। জয়নালের মাথা ঘোরাটা কমে গেছে। তার কেমন শান্তি শান্তি লাগছে। প্রচণ্ড ঘুমও পাচ্ছে। সে ঠিক করে ফেলেছে আজ রাতে আর খাওয়া-দাওয়া করবে না। বাসায় ফিরেই লম্বা ঘুম দেবে।
চা খাওয়া শেষ হবার পর ইতির খালু হঠাৎ বললেন, আমার একটা প্রস্তাব আছে। সব যখন ঠিক ঠাক হয়েই গেল বিয়েটা পিছিয়ে রেখে লাভ কী! একজন কাজি ডেকে বিয়ে পড়িয়ে দেয়া হোক। শুভ কাজ ফেলে রাখতে হয় না।
সবাই চুপ করে আছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। জয়নালের মাথা ঘোরা রোগ আবার শুরু হয়েছে। ইতি যে-রকম বলেছিল সে-রকমটা দেখি হচ্ছে। ইতি দেখি ডেনজারাস মেয়ে।
রাত দশটা বাজার আগেই জয়নালের বিয়ে হয়ে গেল।
জয়নাল তার গুহায় ফিরে এসেছে। তার কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগছে। এখনো চারপাশের সব কিছু দুলছে। তবে এই দুলুনি আরামদায়ক দুলুনি। সে যেন বিরাট কোনো এক বজরার ছাদে শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে ঢেউয়ের ধাক্কায় বজরা দুলছে। আরামে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
ইতিদের বাসায় রাতে খাবারের আয়োজন ছিল। তারা হোটেল থেকে খাবার আনিয়েছিল। জয়নালের শরীর খারাপ লাগছিল বলে কিছু খেতে পারে নি। এখন ক্ষিধে লেগেছে। ঘরে চাল-ডাল আছে। খিচুড়ির মতো রান্না করা যায়। সে ইচ্ছাটাও করছে না। জয়নাল বিছানায় শুয়ে পড়ল। ঘুমে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, তারপরেও সে কষ্ট করে জেগে আছে। আজকের অদ্ভুত দিনটা নিয়ে চিন্তা করতে তার ভালো লাগছে। ঘুমিয়ে পড়লে তো আর চিন্তা করা যাবে না।
দুপুরের ডাকে আসা চিঠিগুলি পড়া হয় নি। এখন পড়া যেতে পারে। আজ চিঠির কোনো দুঃসংবাদই তার কাছে দুঃসংবাদ বলে মনে হবে না। জয়নালের ধারণা ভয়ঙ্কর কোনো দুঃসংবাদ নিয়ে আসা চিঠি পড়লেও তার ভালো লাগবে।
প্রথম যে চিঠি জয়নাল পড়ল সেটা লিখেছে বরকত। বরকতের চিঠি এসেছে এটা জানলে সে আগেই পড়ত। পৃথিবীর সবচে খারাপ হাতের লেখা বরকতের। বরকতের হাতের লেখা পড়ে অর্থ বের করা অত্যন্ত কঠিন। বরকত লিখেছে—
জয়নাল,
তোর সঙ্গে অনেকদিন কোনো যোগাযোগ নেই। এদিকে জেল-টেল খেটে আমি অস্থির। হাঁপানি রোগে ধরেছে। দুঃখধান্ধায় মাথার চুল পেকে বুড়ো হয়ে গেছি। এখন আমাকে দেখলে তুই চিনতে পারবি না। তোর মন খারাপ হয়ে যাবে।
জয়নাল শোন, আমি খবর পেয়েছি তুই সবার কাছে আমেরিকা যাবার টিকিটের টাকার জন্যে ধাধরি করছিস। তোর অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি। আমি নিজেও এর ভেতর দিয়ে গিয়েছি। সেই সময় তুই আমার জন্যে যে ছোটাছুটি করেছিস তা আমার মনে আছে রে দোস্ত। তোর ভালোবাসার ঋণ আমার পক্ষে কোনো দিন শোধ করা সম্ভব না। আমি সেই চেষ্টাও করব না। যাই হোক, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ঢাকাআমেরিকা-ঢাকা একটা ওপেন টিকিট তোর জন্যে পাঠালাম। দোস্ত রে এত দুশ্চিন্তা করিস না। আমি আছি না?
শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। বেশিদিন বাঁচব বলে মনে হয় না। জীবনটা দুঃখ-ধান্ধায় কেটে গেল এই আফসোস।
তুই ভালো থাকিস।
ইতি—বরকত
বৃষ্টি পড়ছে। টিনের চালে বৃষ্টির কী সুন্দর শব্দ! জয়নাল বিছানায় শুয়ে আছে। বরকতের মুখ মনে করার চেষ্টা করছে। কিছুতেই মনে পড়ছে না। মানুষের মস্তিষ্কের এই এক আশ্চর্য ব্যাপার মানব মস্তিষ্ক অতি প্রিয়জনদের চেহারা কখনোই হুবহু মনে করতে পারে না। কল্পনায় আবহু ধোয়াটে ছবি ফুটে উঠে–যে ছবি কখনোই স্পষ্ট হয় না।
বৃষ্টি পড়ছে। আহ কী মিষ্টি ঝুনঝুন শব্দ! এই শব্দটা না হলেই ভালো হতো। ঘুমপাড়ানি গানের মতো শব্দটা ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। জয়নাল ঘুমুতে চায় না। সে জেগে থাকতে চায়। আজ সারা রাত সে জেগে থেকে আনন্দ করবে। মনে মনে কথা বলবে ইতির সঙ্গে। আজ তার জীবনের বিশেষ একটি রাত। বিয়ের রাত। বাসর হচ্ছে না, তাতে কী? গুহার ভেতরে সে নিশ্চয়ই ইতিকে নিয়ে বাসর সাজাবে না। ইতিও কি জেগে আছে? হয়তো জেগে আছে। তার বান্ধবীরা চলে
এসেছে। সবাই মিলে গুটুর গুটুর করে গল্প করছে।
দরজার কড়া নড়ছে। কে আসবে এত রাতে? জয়নাল দরজা খুলল। দশএগারো বছরের একটা অপরিচিত মেয়ে বড় একটা স্যুটকেস হাতে দাঁড়িয়ে আছে। জয়নাল বিস্মিত হয়ে বলল, তুমি কে?
মেয়েটা বলল, আমার নাম ফুলি।
আমার কাছে কী?
আফা আসছে।
আফা আসছে মানে কী? আফা কে?
গেটের কাছে একটা জিপ গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি থেকে ইতি নামছে। ইতির মাথায় ছাতা ধরে আছেন ইতির খালু। ইতি মাথা উঁচু করে জয়নালকে দেখে তার খালুর দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে আসতে হবে না। আপনি থাকুন। আমি ফুলিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।