আপনার স্ত্রী, ছেলে মেয়ে তারা সঙ্গে যাবে না?
আমার স্ত্রী ছেলে কেউ নেই। আমি একা মানুষ।
বিবাহ করি নাই।
আপনার পাসপোর্টে তো দেখি আর কোনো দেশের সিল নেই। দেশের বাইরে কখনো যনি নি?
জি না।
আমেরিকার কোন জিনিসটা দেখার ব্যাপারে আপনার আগ্রহ?
নায়াগ্রা জলপ্রপাতের নাম শুনেছি। এটা দেখার ইচ্ছা আছে।
গ্র্যান্ড কেনিয়ন দেখে আসবেন। দেখার মতো দৃশ্য। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এমট্রেকে চড়বেন–দুই থেকে আড়াইঘণ্টা লাগবে। ট্রেন জার্নিটাও সুন্দর। অবজারভেশন ডেক আছে, আমেরিকা দেখতে দেখতে যাবেন।
জি আচ্ছা জনাব। তবে ক্যালিফোর্নিয়া যেতে পারব বলে মনে হয় না। আমি খুব সামান্য টাকা পয়সা নিয়ে যাব। আমার এক ছাত্র থাকে মেরিল্যান্ডে, তার বাড়িতে থাকব। সে যেখানে যেখানে নিয়ে যায় সেখানে যাব। এর বেশি আমার সাধ্য নাই।
বিকেল তিনটার সময় এসে পাসপোর্ট নিয়ে যাবেন।
জি আচ্ছা।
চারটা হাঁচি দিয়ে তিনি থেমে গিয়েছিলেন। এখন আবার শুরু হলো। তিনি হাঁচি দিয়েই যাচ্ছেন। আমেরিকান ভদ্রলোক অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বিড়বিড় করে কী যেন বলল–হাঁচির শব্দে ভালো শোনা গেল না। তিনি হাঁচতে হাঁচতেই ঘর থেকে বের হলেন। বক ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে তার হাত ধরল। উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ঘটনা কী? ভিসা দিয়েছে? না-কি রিজেকশন?
জানি না।
পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে দিয়েছে?
না। তিনটার সময় এসে নিয়ে যেতে বলেছেন। বলেন কী! তাহলে তো ভিসা পেয়ে গেছেন। বলেছিলাম না পাবেন। তের নাম্বার আনলাকি এটা খুবই বোগাস কথা। পৃথিবীর সবচে লাকি নাম্বার তের। হাঁচি বন্ধ করেন। এখন হাঁচির টাইম না।
তাঁর হাঁচি বন্ধ হয়ে গেল। তিনি বললেন, তোমার নামটা জানা হলো না।
আমার আগে নাম ছিল মোহাম্মদ জয়নাল হোসেন খন্দকার। এখন নাম পাল্টে রেখেছি রোজারিও গোমেজ জয়নাল। চার্চে গিয়ে খ্রিষ্টান হয়ে গেছি। তারপর এফিডেবিট করে নাম বদলেছি।
সে-কী! কেন?
খ্রিষ্টানদের জন্যে ভিসা পাওয়া খুব সুবিধা। আমার দুই বন্ধু খ্রিষ্টান হয়ে বিদেশে ভিসা পেয়ে চলে গেছে। একজন গেছে ফ্রান্সে, আরেকজন অস্ট্রেলিয়া।
ভিসার জন্যে খ্রিষ্টান হয়ে গেলে?
উপরে উপরে হয়েছি। ভিতরে খাঁটি মুসলমান। সময় সুযোগ হলেই মাগরেবের নামাজটা পড়ি। তাছাড়া যিশু খ্রিষ্টও আমাদের নবী ছিলেন। আগে আমি একজন নবীর কেয়ারে ছিলাম। এখন দুইজনের কেয়ারে আছি।
খ্রিষ্টান হয়ে গেছ, বাবা-মা কিছু বলল না?
বাবা-মা কেউ নাই। মামাদের সংসারে মানুষ হয়েছি। তারা এইসব কিছু জানেও না।
শামসুদ্দিন আবারো হাঁচতে শুরু করলেন। জয়নাল বলল, আপনার তো চাচাজি অবস্থা খারাপ, নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। আপনি একজন ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করেন। তারপর বাসায় গিয়ে শান্তিমতো ঘুম দেন। আপনার কাজ তো হয়েই গেল। আসল জায়গায় ভিসা পেয়ে গেছেন। ইউরোপের যে-কোনো দেশের ভিসা এখন চোখ বন্ধ করে পাবেন। পাসপোর্টে আমেরিকান ভিসা দেখলে এরা ঝিম মেরে যায়। আপনি হলেন লাকি ম্যান অব দ্য সেঞ্চুরি।
তোমার ইন্টারভ্যু হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি–তোমার কী হলো জেনে যাই। মনে হচ্ছে তোমার ভিসা পাওয়াটা অত্যন্ত জরুরি।
জয়নাল চোখ বড় বড় করে বলল, সত্যি অপেক্ষা করবেন?
হ্যাঁ করব।
জয়নাল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বিড়বিড় করে বলল, কতক্ষণে ডাক আসে কে জানে!
সমস্যা নাই, অপেক্ষা করি। আমার কোনো জরুরি কাজ নাই।
সামনে বসেন। একটা পর্যন্ত ইন্টারভ্যু চলে, তার আগেই ইনশাল্লাহ আমারটা হয়ে যাবে। চুপচাপ বসে না থেকে আমার জন্যে একটু দোয়া করেন। আপনি হলেন লাকি ম্যান অব দ্য সেঞ্চুরি। আপনার দোয়া আল্লাহ শুনবে।
আমি দোয়া করব।
জয়নাল কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে আবারো এসে তার পাশে বসল। তখন তাকে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হচ্ছে। মুখ বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। শরীর ঘামছে। শামসুদ্দিন বললেন, কী ব্যাপার?
অবস্থা খুবই খারাপ। তিন নম্বর ঘরে একটা মেয়ে ইন্টারভ্য নিচ্ছে। যার ডাক সেই ঘরে পড়ছে সে-ই ধরা খাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে ঐ হারামজাদির ঘরেই ডাক পড়বে। খাজা বাবার দোয়া নিয়ে এসেছিলাম। এবারো হবে না কারণ খ্রিষ্টান হয়ে যাবার কারণে খাজা বাবা রাগ করেছেন।
আবার মুসলমান হয়ে যাও।
মুসলমান তো হয়েই আছি। নতুন করে কী হবো? ভিসা পাওয়ার একটা কৌশল। খাজাবাবা এই সাধারণ জিনিসটা বুঝতে পারছেন না এটা একটা অফিসোস। স্যার, চলেন চা খাই। রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকান আছে, ভালো চা বানায়।
তোমার যদি ভিসা হয় আমাকে খবর দিও।
ভিসা হলেও খবর দিব, না হলেও খবর দিব। একটা পরিচয় যখন হয়েছে।
তুমি পড়াশোনা কতদূর করেছ?
দুবার ইন্টারমিডিয়েট দিয়ে ধরা খেয়েছি। দুবারই নকলের ভালো সুবিধা পেয়েছিলাম। নিশ্চিন্ত মনে নকল করেছি। পরীক্ষার সময় টিচারও ভালো পেয়েছিলাম–নকলে হেল্প করেছেন। তারপরেও কিছু হয় নি। সবই কপাল! কপাল ফেটে তিন চার টুকরা হয়ে আছে। আমেরিকায় যেতে পারলে ফাটা কপাল জোড়া লাগাতাম। কপাল জোড়া লাগানোর আইকা গাম শুধুমাত্র সাদা চামড়াদের দেশেই পাওয়া যায়। আমার কপাল জোড়া লাগে–আল্লাহপাকের সেটাও ইচ্ছা না।
এখনই এত নিরাশ হয়ো না। হয়তো ভিসা পাবে।
পাব না। স্বপ্নেও দেখেছি পাব না। গত রাতে স্বপ্ন কী দেখেছি শুনলেই বুঝবেন। স্বপ্ন দেখেছি পুকুরপাড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি–হঠাৎ পা পিছলে পুকুরে পড়ে গেছি। সাঁতার কেটে পাড়ে উঠতে যাব, সেখানে অদ্ভুত কিছু জন্তু দাঁড়িয়ে আছে–চ্যাপ্টা মুখ, বড় বড় দাত। পাড়ে উঠতে পারছি না। যতবার উঠতে চাই জন্তুগুলি লাথি দিয়ে ফেলে দেয়।