কিছু কি বাড়ানো যায়? আরো দুই?
না।
স্যার, আসুন, কফি খেতে খেতে কথা বলি।
কথা বলতে পারি, তবে কফি খাব না।
চা?
চা এক কাপ খাওয়া যেতে পারে।
আপনার মিসেসকে নিয়ে এলে ভালো হতো। উনি নিজে পছন্দ করতে পারতেন। মেয়েদের শাড়ি-গাড়ির ব্যাপারে নানা খুঁত-খুঁতানি থাকে।
গাড়িটা তাকে দিতে চাচ্ছি সারপ্রাইজ হিসেবে, আগে দেখে ফেললে তো সারপ্রাইজ এলিমেন্ট নষ্ট হয়ে যায়।
তা ঠিক।
আব্দুর রহমান সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিল। জয়নাল সিগারেট নিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে টান দিচ্ছে। তার খুবই মজা লাগছে। মনে হচ্ছে সে সত্যি সত্যিই গাড়ি কিনতে এসেছে।
আচ্ছা এরকম দিন কি তার আসবে না? কেন আসবে না? আসতেও তো পারে। পথের ফকির থেকে মানুষ কোটিপতি হয়। আবার কোটিপতি থেকে কেউ কেউ হয় শুনাপতি। সবই ভাগ্যের খেলা। তার বন্ধু বরকত কোরান শরীফের একটা আয়াত সব সময় বলত–সূরা বনি ইসরাইলে আল্লাহপাক বলছেন—
আমি প্রত্যেক মানুষের ভাগ্য তার গলায় হারের
মতো পরিয়ে দিয়েছি।
আমরা সবাই গলায় অদৃশ্য হার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কার হার কেমন কেউ জানে না।
সাড়ে ছটার সময় জয়নাল শামসুদ্দিন সাহেবকে নিয়ে ইতিদের বাসায় উপস্থিত হলো। ড্রয়িং রুমে ঢোকার মুখেই দুর্ঘটনা। দরজায় ধাক্কা লেগে জয়নালের হাতে ধরা মিষ্টির হাঁড়ি ভেঙে রসগোল্লা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। রসগোল্লার রসে জয়নালের প্যান্ট মাখামাখি হয়ে গেল। মিষ্টির হাঁড়ি ভেঙে যাওয়া বড় কিছু না, দুই কেজি রসগোল্লার দাম একশ আশি টাকা, কিন্তু লক্ষণ অশুভ। শুভদিনে দুর্ঘটনা ঘটা মানেই অশুভ কিছু আছে। জয়নালের বুক টিপটিপ করছে। বোঝাই যাচ্ছে গণ্ডগোল একটা লাগবেই।
ইতিদের বসার ঘরে এক গাদা মানুষ। হাঁড়ি ভাঙা রসগোল্লার কয়েকটা বসার ঘরেও ঢুকেছে। তারা সবাই তাকিয়ে আছে সেই দিকে। সবার মুখই গম্ভীর। ইতির খালু সাহেব শুকনা গলায় বললেন, সাবধানে আসুন। মিষ্টিতে পা পড়লে আছাড় খাবেন। অতিরিক্ত সাবধান হতে গিয়েই জয়নাল মিষ্টির রসে পা দিল। উল্টে পড়তে পড়তে শামসুদ্দিন সাহেবকে ধরে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাল। এই প্রক্রিয়ায় লাভের মধ্যে লাভ হলো জয়নালের হাতে ধরা অন্য হাড়িগুলিও মেঝেতে ছিটকে পড়ল। দুর্ঘটনা একটার পর একটা ঘটতে শুরু করেছে–এরপরে কপালে কী আছে? জয়নালের কেমন যেন বমি বমি আসছে। পেটের ভেতর মোড় দিচ্ছে। ঘর-বাড়ি দুলছে। সবার সামনে সে বমি করে দেবে না তো? হয়তো দেখা যাবে বিয়ের আলাপের এক পর্যায়ে সে হড়হড় করে ইতির আলুর গায়ে বমি করে দিল। বিয়ের আলাপ-আলোচনা এখানেই সমাপ্তি।
জয়নালের শুধু যে বমি পাচ্ছে তা না, বাথরুমও পেয়ে গেছে। তার যে এত প্রবল বাথরুম পেয়েছিল তা আগে বোঝা যায় নি। আগে বুঝতে পারলে রাস্তার পাশে দাড়িয়ে হালকা হয়ে আসত। এখন বোঝা যাচ্ছে। তলপেট টনটন করছে। এই মুহুর্তেই বাথরুমে যাওয়া দরকার। বাথরুমে যেতে পারলে বমির কাজটাও সেরে ফেলা যেত। সবচে ভালো হতো একটী গোসল দিতে পারলে। মাথা গরম হয়ে আছে। মাথায় পানি ঢালতে হবে। বিশ-পঁচিশ মিনিট পানি ঢাললে মাথাটা ঠাণ্ডা হতো।
ইতির বাবা জয়নালের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কি শরীর খারাপ?
জয়নাল বলল, জি স্যার শরীর খারাপ। আমার বাথরুমে যাওয়া দরকার। বাথরুমটা কোন দিকে?
জয়নালকে বাথরুম দেখিয়ে দেয়া হয়েছে। সে হেলতে দুলতে বাথরুমের দিকে যাচ্ছে। নতুন চশমা পরলে মেঝে যেমন উঁচু নিচু লাগে তার কাছেও এখন সে-রকম লাগছে। মাথা ঘুরাটা অনেকখানি বেড়ে গেছে। দেয়াল ধরে ধরে এগুতে পারলে ভালো হতো। সেটা ঠিক হবে না। ইতিদের বসার ঘরের সবাই ভাববে জামাই দেয়াল ধরে ধরে যাচ্ছে কেন? সে কি কোনোখান থেকে মাল টেনে এসেছে? ইতির বাবাকে স্যার ডাকাও ঠিক হয় নি। সবই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আরো এলোমেলো হবে। এতটা সময় পার হয়েছে এখনো একবার আল্লাহ-খোদার নাম নেয়া হয় নি। আল্লাহর নিরানব্বইটা নামের মধ্যে একটা নাম আছে যা বারবার জপ করলে সমুদয় বিপদ কেটে যায়। কত অসংখ্যবার এই নাম জয়নাল জপ করেছে, আজ কিছুতেই নামটা মনে পড়ছে না। আল্লাহরই ইচ্ছা নেই সে বিপদ থেকে পার হয়। আল্লাহর ইচ্ছা থাকলে তার নাম মনে পড়ত। নামটা ম দিয়ে এইটুকু শুধু মনে পড়ছে।
বিয়ের আলাপ-আলোচনার শুরুতেই গণ্ডগোল লেগে গেল। মেয়ের বাবা শামসুদ্দিন সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি ছেলের আপন চাচা?
শামসুদ্দিন বললেন, জি না।
মেয়ের বাবা বললেন, জয়নাল তো বলেছিল আপনি তার আপন চাচা। তার মানে কী? জয়নাল মিথ্যা কথা বলেছে? এমন মিথ্যাবাদী ছেলের সঙ্গে তো আমি মেয়ে বিয়ে দেব না। অসম্ভব।
এরকম কঠিন কথার পর বিয়ের আলোচনা অগ্রসর হবার কোনো কারণ থাকে না। আলোচনা থেমে গেল। সবাই চুপচাপ বসে রইল। নীরবতা ভঙ্গ করে শাসুদ্দিন বললেন, অনেক দূরের মানুষও মাঝে মাঝে খুব আপন হয়। সেই অর্থে সে আপন বলেছে। মিথ্যা বলে নাই।
মেয়ের বাবা বললেন, মিথ্যা বলে নাই?
শামসুদ্দিন বললেন, জি না। তার বিষয়ে সে কোনো কিছুই আপনাদের কাছে গোপন করে নাই। সে বলে নাই যে তার দেশের বাড়িতে বিরাট বিষয়-সম্পত্তি আছে। বড় বড় আত্মীয়স্বজন আছে। সে যা তাই বলেছে। বিয়ের আলাপআলোচনায় সে নিশ্চয়ই কারো না কারো কাছ থেকে একটা গাড়ি জোগাড় করে সেই গাড়িতে করে আসতে পারত। তা না করে সে আমাকে নিয়ে বেবিটেক্সিতে করে এসেছে। তার স্বভাবের মধ্যে যদি মিথ্যা থাকত, ভান থাকত তাহলে অনেক কায়দা দেখাবার চেষ্টা সে করত। সে আমাকে আপন চাচা বলেছে কারণ সে মন থেকে এই ব্যাপারটা বিশ্বাস করে বলেই বলেছে। আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন সে কিন্তু তার কোনো আত্মীয়স্বজনকে অনে নি। আমাকে নিয়ে এসেছে।