পৃথু!
রাহেলার কঠিন গলা শুনে পৃথু শক্ত হয়ে গেল। কান্নাটা থেমে গিয়েছিল, আবার তা ফিরে আসছে বলে মনে হলো। গলার কাছে শক্ত হয়ে গেছে। এটা কান্না আসার লক্ষণ।
কথা বলছ না কেন, পৃথু?
কী মা!
দরজার আড়াল থেকে বের হয়ে আস।
পৃথু দরজার আড়াল থেকে বের হয়ে এলো। রাহেলা চাপা-গলায় বলল, কাল এইভাবেই স্কুলে যাবে। মনে থাকবে?
পৃথু হাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
স্কুলের সবাই যখন জিজ্ঞেস করবে এই অবস্থা কেন? তখন বলবে আমি প্রতিরাতে বিছানা ভিজিয়ে ফেলি এই জন্যে এটা আমার শাস্তি। বলতে পারবে না?
পৃথু আবারো হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
এখন আমার সামনে থেকে যাও। আমার মাথা ধরেছে, আমি দরজা বন্ধু করে শুয়ে থাকব। খবরদার! প্যান্ট পরবে না। যেভাবে তোমাকে থাকতে বলেছি সেইভাবে থাকবে।
পৃথু আবারো মাথা নাড়ল। সে এক হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে আছে। কারণ তার কান্না এসে যাচ্ছে, কান্নাটা আটকানো দরকার। পৃথু চুপিচুপি শামসুদ্দিন সাহেবের ঘরের খাটের নিচে চলে গেল। খাটের নিচে লুকিয়ে বসে থাকলে কেউ তার এই অবস্থাটা দেখবে না।
শামসুদ্দিন দেখে ফেললেন। তিনি পৃথুকে কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। নিজের একটা লুঙ্গি ছোট করে পৃথুকে পরিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। পৃথু ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তিনি কিছুই জিজ্ঞেস করছেন না। এটাও পৃথুর খুব ভালো লাগছে। শান্তি শান্তি লাগছে। ঘুম এসে যাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়লে সে হয়তো এই বিছানাও ভিজিয়ে দেবে। তাতে কোনো অসুবিধা হবে না। বড় মামা তাকে কিছুই বলবেন না। কাউকে জানাবেনও না। বড় মামার বিছানা সে আগেও কয়েকবার ভিজিয়েছে। বড় মামা প্রতিবারই বলেছেন, কাণ্ড দেখেছিস পৃথু রাতে পানি খাবার সময় বিছানায় পানি ফেলে দিয়েছি। মনে হয় তোর প্যান্টও ভিজিয়ে ফেলেছি। যা, তাড়াতাড়ি প্যান্ট বদলে আয়।
পৃথু!
জি বড় মামা।
আজ বিকেলে আমার সঙ্গে বেড়াতে যাবি?
কোথায়?
পার্কে খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করব, তারপর যাব দোকানে। তুই যদি কিছু কিনতে চাস কিনে দেব।
আচ্ছা।
বড় মামা এখনো পিঠে হাত বুলাচ্ছেন। কী যে আরাম লাগছে! কারো কারো হাতে খুব মায়া থাকে। গায়ে হাত বুলালেই মায়ায় শরীর ভরে যায়। পৃথু ঘুমিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরেই রাহেলা ছেলের খোঁজে ঘরে ঢুকল। শামসুদ্দিন বললেন, ওকে ডাকিস না। ঘুমাচ্ছে। সামান্য জ্বরও মনে হয় এসেছে। গা গরম।
রাহেলা বলল, ও যে আমাকে কী যন্ত্রণা করছে ভাইজান! একটাতেই এই অবস্থা, দুনম্বরটা আসলে কী যে হবে!
শামসুদ্দিন বললেন, তুই এই চেয়ারটায় বেসি।
রাহেলা বিস্মিত হয়ে বলল, কেন? কিছু বলবে? পৃথুর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি এটা নিয়ে উপদেশমূলক কথা বলবে?
না। আমি কখনো কাউকে উপদেশ দিই না। তুই আরাম করে বোস।
রাহেলা বসল। শামসুদ্দিন টেবিলের ড্রয়ার খুলতে খুলতে বললেন, তোর জন্যে সামান্য উপহার এনেছি। এই নে।
রাহেলা থমথমে গলায় বলল, এইগুলো কখন কিনেছ?
কখন কিনেছি এটা দিয়ে তোর দরকার কী?
দরকার আছে। আমার ধারণা তুমি সেন্টের বোতল দুটা গত পরশু কিনেছ।
আমার মনে নেই, হতে পারে।
হতে পারে-টারে না। অবশ্যই তুমি গত পরশু কিনেছ। কীভাবে বুঝলাম সেটাও তোমাকে বলি। বললে তুমি বিশ্বাস করবে না, তারপরও বলি–আমি স্বপ্নে দেখেছি।
শামসুদ্দিন বিস্মিত হয়ে বললেন, স্বপ্নে দেখেছিস?
হুঁ, পরশু রাতে স্বপ্নে দেখেছি। কী স্বপ্ন সেটা তোমাকে বলা ঠিক হবে না।
বলা ঠিক না হলে বলতে হবে না।
আচ্ছা ঠিক আছে, কী স্বপ্নে দেখেছি তোমাকে বলি। না বললে শান্তি পাব না। আমার কোনো স্বপ্ন ফলে না। এটা কীভাবে ফলল কে জানে। খুবই অবাক লাগছে। ভাইজান, দেখ আমার গায়ে কাঁটা দিয়েছে। চোখে দেখে গায়ের কাটা বোঝা যাবে না। হাত দিয়ে দেখ। আমার গায়ে হাত রাখলে তোমার হাত পচে যাবে না। আমার এইডস হয় নি।
তোর গায়ে যে কাঁটা দিয়েছে এটা খালি চোখেই দেখতে পাচ্ছি। এখন স্বপ্নটা কী বল।
স্বপ্নে দেখেছি আমি তোমার সঙ্গে আমেরিকা গিয়েছি। দুজন হাঁটছি। রাস্তার দুপাশে বিশাল বড় বড় দোকান। একেকটা দোকান এত বড় যে আকাশ দেখা যাচ্ছে না। চারদিকে খুব শব্দ হচ্ছে। একটু পরপর মাথার উপর দিয়ে জেট প্লেন উড়ে যাচ্ছে। আমার খুবই ভয় লাগছে। তুমি বললে, আয় একটা দোকানে ঢুকে দেখি এদের দোকানগুলো কেমন। আমি তোমার সঙ্গে দোকানে ঢুকলাম। দোকানটা হলো পারফিউমের। রাজ্যের পারফিউম। কেনার সাধ্যও নাই, এত দাম। দোকানের একজন সেলসগার্ল আমাদের দেখে এগিয়ে এসে বলল, আপনারা কি প্রথম আমাদের দোকানে এসেছেন? তুমি বললে, হ্যাঁ। সেলসগার্ল বলল, প্রথম যারা আমাদের দোকানে আসে তাদেরকে একটা করে ফ্রি পারফিউম দিই। তোমরা দুজন তোমাদের পছন্দমতো দুটা পারফিউম বেছে নাও। তখন আমি ছুটে গিয়ে দুটা বেছে নিয়ে নিলাম। আমারটাও নিলাম। তোমারটাও নিলাম। এই হলো স্বপ্ন। অদ্ভুত স্বপ্ন না ভাইজান?
হুঁ।
ভাইজান শোন, তুমি যে আমাকে দুটা পারফিউম কিনে দিয়েছ এটা পৃথুর বাবাকে জানিও না।
কেন?
সে অন্য কিছু ভেবে বসতে পারে। কী দরকার!
অন্য কিছু ভাববে কেন?
ভাবলে আমি কী করব? আমি তো আর অন্যের ভাবনা কনট্রোল করতে পারি না। এই বিষয়ে তুমি পৃথুর বাবার সঙ্গে কোনো কথা বলবে না।
আচ্ছা।
রাহেলা চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে চাপা গলায় বলল, এত কিছু থাকতে তুমি বেছে বেছে আমার জন্যে পারফিউম কেন কিনেছ বলো তো? আচ্ছা থাক, বলতে হবে না। আমি জানি কেন কিনেছ।