ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললে হয় না?
কথা বলেছি। ডাক্তার বলেছে এটা এমন কিছু না। হরমোনাল ইমব্যালান্স থেকে এরকম হয়। ঠিক হয়ে যাবে। আমাকে বলেছে তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে খুশি রাখার চেষ্টা করতে। আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। রাহেলা যাই বলছে আমি তাতেই সায় দিচ্ছি। রাহেলা বলল, বিছানা ভিজাননার শাস্তি হিসেবে পৃথু সারাদিন পান্ট ছাড়া থাকবে। আমি বলেছি, অবশ্যই তাই থাকবে। ভাইজান কি চায়ের সঙ্গে একটা সিগারেট খাবেন?
শামসুদ্দিন সিগারেট নিলেন। রফিক সিগারেট ধরিয়ে দিতে দিতে বলল, রাহেলাকে খুশি করার আরেকটা বুদ্ধি বের করেছি ভাইজান!
কী বুদ্ধি?
ভালো সেন্ট ওর পছন্দ। ভালো সেন্টের এমন দাম, কিনে দেওয়া সম্ভব না। তারপরও দু বোতল সেন্ট কিনে এনেছি। সেন্ট পেলে সে এক সপ্তাহ খুশি থাকবে। ফুস ফুস করে গায়ে সেন্ট ছাড়বে আর হাসবে।
রাহেলার সেন্ট এত পছন্দ জানতাম না তো!
খুবই পছন্দ। মাঝে মাঝে যখন দোকানে নিয়ে যাই ও কী করে জানেন? দুনিয়ার সেন্ট নেড়ে-চেড়ে দেখে। হাতে স্প্রে করে। গন্ধ শোঁকে। তখন তাকে দেখলে আপনার মনে হবে সে জগতের সুখী মহিলাদের একজন।
বলো কী!
রফিক সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, সেন্টের শিশি দুটা আমি আপনার ড্রয়ারে রেখে দিচ্ছি ভাইজান। এক সময় তাকে ডেকে বলে দেবেন যে আপনি তার জন্যে কিনে এনেছেন। আপনার কাছ থেকে সেন্ট পেলে সে অনেক বেশি খুশি হবে।
শামসুদ্দিন তাকিয়ে রইলেন। সেন্টের শিশি তিনি দিলে রাহেলা বেশি খুশি হবে কেন ঠিক ধরতে পারছেন না।
রফিক বলল, আমার উপরে সে নানান কারণে রেগে আছে। আমি যদি দিই তাতে লাভ হবে না। হয়তো ছুড়ে ফেলে দেবে। দামি একটা জিনিস নষ্ট হবে।
শামসুদ্দিন বললেন, আমি সেন্টের শিশি দিয়ে তাকে কী বলব?
বলবেন আপনি তার জন্যে কিনেছেন।
মিথ্যা কথা বলা হবে তো।
সংসারে থাকতে হলে দুএকটা মিথ্যা কথা বলতে হয় ভাইজান। এতে দোষ হয় না। তারপরও আপনার যদি খারাপ লাগে আপনি আমাকে টাকা দিয়ে দেবেন। নেন, আরেকটা সিগারেট নেন। দেশে যেমন যে-কোনো জায়গায় আরাম করে সিগারেট ধরাতে পারবেন, আমেরিকায় পারবেন না। স্মোকিং ওরা দেশ থেকে তুলে দিচ্ছে। খুব হেলথ কনশাস জাতি।
শামসুদ্দিন আরেকটা সিগারেট ধরালেন। পৃথুর ফেঁপানি শোনা যাচ্ছে না। তিনি এতে স্বস্তি পাচ্ছেন। মনে হচ্ছে তার উপর দিয়ে ঝড় যা যাবার চলে গেছে। বাচ্চাটা আজকের মতো রেহাই পেয়েছে। শামসুদ্দিন মনে মনে ঠিক করে ফেললেন আজ বিকেলে পৃথুকে নিয়ে বের হবেন। তার পছন্দের কোনো খেলনা কিনে দেবেন। একটা কোন-আইসক্রিম কিনে দেবেন। বাবার হাত ধরে আইসক্রিম খেতে খেতে বাচ্চা একটা ছেলে গুট গুট করে এগুচ্ছে। কী সুন্দর দৃশ্য। পৃথুর মতো একটা ছেলে যদি তার থাকত!
পৃথু দরজার আড়ালে দাড়িয়ে আছে। তার খুবই লজ্জা লাগছে, কারণ তার পরনে প্যান্ট নেই। তার গায়ে হালকা গোলাপি রঙের একটা হাফশার্ট। শার্টের ঝুল এমন যে তার লজ্জা ঢাকা পড়ে। ঘরের ভেতর শুধু শার্ট পরে থাকতে হচ্ছে এই লজ্জাতেই সে মরে যাচ্ছে। লজ্জার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভয়, কারণ মা একটু আগে বলেছে পঞ্চকে এইভাবেই কাল স্কুলে যেতে হবে। মা এত নিষ্ঠুর আচরণ করবে বলে পৃথুর মনে হয় না। তবে করতেও পারে। রেগে গেলে মা নিষ্ঠুর আচরণ করে। সত্যি সত্যি তাকে যদি কাল এইভাবে স্কুলে যেতে হয় তাহলে কী হবে! সবাই তাকিয়ে থাকবে তার দিকে। হাসাহাসি করবে। ক্লাসের টিচার বলবেএই পৃথু, ছিঃ ছিঃ তুমি নেংটো হয়ে স্কুলে এসেছ কেন?
মার রাগ কি এর মধ্যে পড়বে না? অবশ্যই পড়বে। পৃথু মনে মনে বলল, আল্লাহ, মায়ের রাগ কমিয়ে দাও। গত শবেবরাতে মায়ের রাগ কমাবার কথাটা আল্লাহকে বলা দরকার ছিল। শবেবরাতে সে আল্লাহর কাছে অনেক কিছু চেয়েছে শুধু এই জিনিসটা চাইতে ভুলে গেছে। বিরাট ভুল হয়েছে। শবেবরাতে সে আল্লাহর কাছে যে সব জিনিস চেয়েছে তার মধ্যে আছে–
একটা ফুটবল (পাম্পারসহ)
একটা পেনসিল বক্স : (ডোনাল্ড ডাকের ছবিওয়ালা। তাদের ক্লাসের একটা মেয়ের আছে। মেয়েটির নাম অমি। মেয়েটা খুব ভালো।)।
বেনানা ইরেজার : (কলার মতো দেখতে ইরেজার। ইরেজারটার গায়ে পাকা কলার গন্ধ। মুস্তাক নামের একটা ছেলের আছে। ছেলেটা খুবই দুষ্ট। সবার সঙ্গে মারামারি করে।
তালাচাবি দেয়া খাতা; (চাবি দিয়ে রাখলে এই খাতা খোলা যায়। শান্তনুর এরকম খাতা আছে। শান্তনু হিন্দু। তার কোনোদিন মুসলমানি হবে না।)
দুই পকেটওয়ালা ফুলপ্যান্ট : (তাদের ক্লাসের সিরাজের এরকম প্যান্ট আছে। অনেকগুলি পকেট। প্যান্টের হাঁটুর কাছে জিপার আছে। জিপার খুললে ফুলপ্যান্টটা হাফপ্যান্ট হয়ে যায়।)
একটা পাজেরো জিপগাড়ি; (তাদের ক্লাসের মীরা নামের মেয়েটা এরকম গাড়িতে করে আসে। তাদের গাড়ির রঙ কালো। পৃথু আল্লাহর কাছে লাল রঙের গাড়ি চেয়েছে। মীরা মেয়েটাকে পৃথুর খুবই ভালো লাগে। পৃথু ঠিক করেছে সে কোনোদিন বিয়ে করবে না। তারপরও তাকে যদি বিয়ে করতেই হয় তাহলে সে মীরাকেই বিয়ে করবে। মীরা পৃথুকে পৃথু ডাকে না। ডাকে পৃথিবী। এটাও পৃথুর খুব ভালো লাগে। নাম বদলাবার কোনো ব্যবস্থা থাকলে সে নিজের নাম বদলে পৃথিবী রাখত। মনে হয় এরকম কোনো ব্যবস্থা নেই।)
অনেকক্ষণ হলো দরজার আড়ালে পৃথু দাঁড়িয়ে আছে। তার পানির পিপাসা পেয়েছে, কিন্তু পানি খাবার জন্যে দরজার আড়াল থেকে বের হবার সাহস পাচ্ছে। মা খাটে বসে আছেন। বের হলেই সে সরাসরি মায়ের সামনে পড়ে যাবে। পৃথুর কাছে আলাউদ্দিনের দৈত্যের চেরাগটা থাকলে দৈত্যকে বলত এক গ্লাস পানি এনে দিতে। অলিউদ্দিনের দৈত্যের চেরাগ যাদের কাছে আছে তারা কতই সুখী।