ইতি
আপনার স্নেহের জয়নাল
ইতির ডিম খাওয়া শেষ হয়েছে, সে পানি খেল, শাড়ির আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে বলল, চিঠিটা ছিড়ে ফেলে দিন। এই চিঠিতে কাজ হবে না। আরেকটা চিঠি লিখুন—
চাচাজি, আমার সালাম নিন। পত্রে জানলাম বাবার কাছ থেকে আপনি বসত-বাড়ি কিনে নিয়েছিলেন। খবরটা জানা ছিল না বলে আপনাকে এমন একটি চিঠি লিখেছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন। জমির দলিল এবং খাজনার রশিদ দেখাতে চেয়েছেন। চাচাজি, তার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনার মুখের কথাই যথেষ্ট। এখন চাচাজি আমি বিপদে পড়েছি। আমেরিকা যাবার ভাড়া জোগাড় করতে পারছি না। আপনি যদি আমেরিকা যাবার টিকিটের টাকা আমাকে ধার দেন তাহলে খুব উপকার হয়। চাচাজি, আপনি আমার এই উপকারটা করুন। আমি অবশ্যই তিন থেকে চার মাসের মধ্যে টাকাটা ফেরত দেব। চাচিজিকে আমার সালাম।
ইতি
আপনাদের স্নেহের জয়নাল
ইতি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, যেভাবে বললাম, ঠিক সেইভাবে চিঠি লিখে দেখুন উনি যদি কিছু পাঠান সেটাই হবে আপনার লাভ। অন্য কোনোভাবে কিছু করতে পারবেন না।
জয়নাল মুগ্ধ চোখে ইতির দিকে তাকিয়ে আছে। এমন এক আশ্চর্য মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হতে যাচ্ছে ভাবতেই কেমন লাগছে।
পৃথু কাঁদছে
পৃথু কাঁদছে।
শামসুদ্দিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছেলেটার কান্না শুনছেন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। বেচারা কান্না বন্ধ করার চেষ্টা করছে, পারছে না। নিশ্চয়ই কোনো কঠিন শাস্তির ভেতর দিয়ে তাকে যেতে হচ্ছে। শামসুদ্দিনের ইচ্ছা করছে ছেলেটাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেন। সকালে ঘুম ভাঙবে বাচ্চা একটা ছেলের কান্নায় এটা কেমন কথা? রাহেলাকে কি বুঝিয়ে ব্যাপারটা বলা যায়?
শামসুদ্দিন উঠে বসেছেন। কী করবেন মনস্থির করতে পারছেন না। রফিক বাসায় আছে। তার কথা শোনা যাচ্ছে। ছেলের মহাবিপদ হলে সে এগিয়ে যাবে, কাজেই তাকে খুব বেশি চিন্তিত না হলেও হবে। তিনি ঘড়ির দিকে তাকালেন, আটটা পাঁচ। অনেক বেলা হয়ে গেছে। অন্যদিন ভোর ছটার আগেই তার ঘুম ভাঙে। আজ আটটা পর্যন্ত একটানা ঘুমিয়েছেন। গত রাতে ঘুম ভালো হয়েছে। শরীর প্রফুল্ল। শুধু পৃথুর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদার কারণে মনটা খারাপ হয়ে আছে। এমন কোনো দোয়া কি আছে যা পড়লে মায়ের মনে শিশুদের প্রতি করুণা জাগে?
ভাইজানের ঘুম ভেঙেছে?
শামসুদ্দিন দেখলেন হাসিমুখে রফিক ঢুকেছে। তার হাতে ট্রে। ট্রেতে দুকাপ চা। একটা পিরিচে দুটা টোস্ট বিস্কিট। এক গ্লাস পানি। রফিক টেবিলে
ট্রে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, বেড-টি এনেছি।
শামসুদ্দিন বললেন, এখনো মুখ ধোয়া হয় নি।
রফিক হাসতে হাসতে বলল, বেড-টি বাসিমুখে খেতে হয়। বিদেশে যাচ্ছেন বেড-টি খেতে হবে। এখন থেকে প্র্যাকটিস করুন। খুব বেশি অস্বস্তি লাগলে কুলি করে নিন। বাসিমুখে চা খেতে পারবেন না ভেবেই পানি নিয়ে এসেছি। বেড-টি খাওয়ার নিয়ম অবশ্যি তা না। প্রথম যে জিনিসটা মুখে ঢুকবে সেটা হচ্ছে গরম চা, কিংবা গরম কফি। গরম পানিতে মুখের ময়লা ধুয়ে স্টমাকে চলে যাবে। মুখ হবে ক্লিন।
শামসুদ্দিন বললেন, পৃথু কাঁদছে কেন?
রফিক বলল, তাকে নাঙ্গু বাবা করা হয়েছে, এই জন্যে কাঁদছে।
নাঙ্গু বাবা মানে কী?
আবার বিছানা ভিজিয়েছে বলে রাহেলা তাকে শাস্তি দিয়েছে। পৃথু আজ সারাদিন কোনো প্যান্ট পরতে পারবে না। নেংটো হয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে। পৃথু কাঁদছে লজ্জায়।
শামসুদ্দিন মন খারাপ করে বললেন, বাচ্চা একটা ছেলেকে এটা কেমন শাস্তি?
রফিক বলল, আপনি আরাম করে চা-টা খান তো ভাইজান! আমি পৃথুকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করব। রাহেলার মেজাজ আজ অতিরিক্ত খারাপ, এই জন্যে তাকে ঘাটাচ্ছি না। মেজাজ নামুক।
শামসুদ্দিন চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। পৃথুর ফুঁপিয়ে কান্নাটা মন থেকে দূর করতে পারছেন না।
রফিক বলল, চা-টা ভালো হয়েছে ভাইজান? আমি বানিয়েছি।
ভালো হয়েছে।
আজ এক কৌটা কফি কিনে আনব। কফি খাওয়ার অভ্যাস হওয়া দরকার। আমেরিকায় শুনেছি সবাই কফি খায়। চায়ের চল নেই। বৃটিশরা চা ভক্ত।
কফি আনতে হবে না রফিক।
ভাইজান, যাবার তারিখ কি ঠিক হয়েছে?
খুব সম্ভব আগামী মাসের ৭ তারিখে যাব। জয়নাল ছেলেটা সে-রকমই ঠিক করেছে।
জয়নালের সঙ্গে এখনো ঝুলে আছেন? বললাম না এই ছেলের কাছ থেকে দূরে থাকতে! আমেরিকায় পৌঁছেই এই ছেলে আপনার ডলার নিয়ে কেটে পড়বে।
ছেলেটা ভালো।
আপনার কাছে তো সবই ভালো। আমার সাবধান করে দেবার কথা, সাবধান করে দিলাম। আগামী মাসের সাত তারিখে চলে যাবেন, হাতে তো তাহলে সময় একেবারেই নেই। আপনার কী কী খেতে ইচ্ছা করে দয়া করে বলবেন। ব্যবস্থা করব।
শামসুদ্দিন বললেন, তুমি এমনভাবে কথা বলছ যেন আমি মারা যাচ্ছি। মৃত্যুর আগে প্রিয় খাবারগুলি খেতে হবে।
সাত সমুদ্র তের নদী পার হচ্ছেন। দেশী খাওয়া-খাদ্য কতদিন পাবেন না। কচুর লতি, মলা মাছ, উচ্ছে ভাজি, মাষকলাইয়ের ডাল–আমেরিকায় এইসব পাবেন না।
আমার খাওয়া নিয়ে তুমি মোটেই চিন্তা করবে না। তুমি রাহেলার দিকে একটু নজর দাও। ইদানীং তার মেজাজ এত খারাপ হয়েছে।
রফিক সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, মেজাজ আসলেই বেশি খারাপ হয়েছে। পেটের সন্তান খালাস না হওয়া পর্যন্তু মেজাজ ঠিক হবে না। পৃথু যখন পেটে ছিল তখনো এরকম মেজাজ খারাপ থাকত। একবার তো ছাদে গিয়ে উঠল–তিনতলা থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়বে এরকম প্ল্যান। আমি হাতে পায়ে ধরে নামিয়ে এনেছিলাম। একেক মেয়ের একেক নেচার।