আরে না, পানি আসবে কেন। একটা জিনিস খুঁজছি। কোথায় যে রাখলাম।
জিনিসটা কী?
জয়নাল জবাব দিতে পারল না। আগে থেকে ঠিকঠাক করে না রাখলে মিথ্যা বলা বেশ কঠিন। ইতি বলল, আপনাকে একটা ব্যাপার বলা দরকার। আমার কিন্তু খুব বুদ্ধি। আমাকে বিয়ে করে আপনি মহাবিপদে পড়বেন, কাজেই আনন্দে চোখের পানি ফেলার মতো কোনো ঘটনা ঘটে নি।
বিপদে পড়ব কেন?
বিপদে পড়বেন কারণ আমি খুবই বুদ্ধিমতী একজন মেয়ে। প্রেম করার জন্যে বুদ্ধিমতী মেয়ে ভালো। বিয়ে করার জন্য বুদ্ধিমতী মেয়ে ভালো না। বিয়ে করার জন্যে ভালো জি জনাব টাইপ মেয়ে! স্বামী যা বলবে মেয়ে ঘাড় কাত করে বলবে–জি জনাব। স্বামী যদি নামাজি হয় সে সঙ্গে সঙ্গে বোরকা পরা শুরু করবে। স্বামীর যদি মদ খাওয়ার অভ্যাস থাকে সেও মদ ধরবে।
জয়নাল মুগ্ধ হয়ে ইতির কথা শুনছে। তার কাছে মনে হচ্ছে, এই মেয়ে চ্যাঙ বেঙ টাইপ মেয়ে না। এ হলো সিরিয়াসিং কন্যা। যে কন্য সব বিষয়ে সিরিয়াস সেই কন্যাই সিরিয়াসিং কন্যা।
ইতি বলল, এখন আপনি ঝেড়ে কাশুন। আয়োজন করে বিয়ে করার মতো টাকা পয়সা কি আপনার আছে?
না।
ধারটার করে জোগাড় করতে পারবেন?
টিকিটের টাকার জোগাড় এখনো হয় নি।
আমার কাছে বুদ্ধি চান?
চাই।
আমার দায়িত্ব হলো–বিয়েতে সবাইকে রাজি করানো। সেটা আমি করাব।
কীভাবে?
আমি শুধু আমার মাকে রাজি করবি। আমার মাও আমার মতোই বুদ্ধিমতী। তিনি রাজি হলে বাকি সবাইকে তিনিই রাজি করাবেন। তখন আপনাদের খবর দেওয়া হবে পান-চিনির অনুষ্ঠানে। আপনি একটা আংটি নিয়ে উপস্থিত হবেন। আংটি কেনার পয়সা কি আছে?
আছে।
আংটি প্রদান অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন হবার পর আপনার চাচা শামসুদ্দিন সাহেব কথায় কথায় বলবেন বিয়ে বাকি রেখে লাভ কী? একটা কাজি ডেকে নিয়ে বিয়ে পড়িয়ে দিলে কেমন হয়। আপনার চাচার এই কথার পর আমাদের তরফ থেকে একজন বলবে, মন্দ কী? তারপর কাজি আনতে লোক চলে যাবে।
এত সহজ?
অবশ্যই সহজ। আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না?
না।
আপনাকে যেভাবে বলেছি পুরো ঘটনা আমি এইভাবে ঘটাব। কোনো রকম উনিশ-বিশ হবে না।
জয়নাল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মেয়েটির আহ্লাদি ধরনের কথার সঙ্গে তার পরিচয় আছে। এই রূপের সঙ্গে পরিচয় নেই। ইতি মাখা দোলাতে দোলাতে বলল, এই কাজটা আমি কেন করছি জানতে চান? আপনার মনে যাতে কোনো ভ্রান্ত ধারণা না থাকে সে জন্যেই আমার বলে দেওয়া উচিত কাজটা কেন করছি। আপনি মজনু না, আমিও লাইলি না যে আপনার প্রেমে দিওয়ানা হয়ে এই কাজ করছি। আমার দিক থেকে কারণটা সহজ। খুবই সহজ। আপনি বোকা টাইপের হলেও মানুষ হিসেবে ভালো। যে-কোনো মেয়ে ভালো মানুষ মন্দ মানুষ ব্যাপারটা ধরতে পারে। যে-কোনো মেয়ের চেয়ে আমি আরো তাড়াতাড়ি ধরতে পারি।
ও, আচ্ছা।
আংটি প্রদান অনুষ্ঠানকে বিয়ের অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা কেন করেছি সেটাও বলি। আপনার প্রতি মমতাবশত এই কাজটা কিন্তু আমি করছি না। আমার বাবার প্রতি মমতাবশত কাজটা করছি।
জয়নাল বলল, তুমি কী বলছ বুঝতে পারলাম না।
বাবা সরকারি চাকরি করেন। আগামী বছর রিটায়ার করবেন। সরকারি বাসা ছেড়ে আমাদের একটা ভাড়া বাড়িতে উঠতে হবে। সেই বাড়ির ভাড়া বাবা কীভাবে দেবেন তা তিনি জানেন না। প্রভিডেন্ট ফান্ডে কোনো টাকা নেই। আমার বড় বোনের বিয়ের সময় এক লাখ টাকা ধার নিয়েছিলেন, সেই ঋণ এখনো শোধ হয় নি। বাবার যা অবস্থা আমার বিয়েতে দশ হাজার টাকা খরচ করার সামর্থ্যও তার নেই। ফাঁকতালে আমার বিয়ে হয়ে গেলে বাবার জন্যেও সুবিধা। টাকা-পয়সা ছাড়া আমার বিয়ে হয়ে গেলে বাবার উচিত কবি নজরুলের বিখ্যাত গানটা গাওয়া–রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
জয়নাল মুগ্ধ গলায় বলল, তুমি দেখি খুবই আশ্চর্য মেয়ে!
ইতি বলল, আমি মোটেই আশ্চর্য মেয়ে না। আমি সাধারণ মেয়ে, তবে বুদ্ধিমতী মেয়ে। আমার বুদ্ধি নিয়ে চললে আপনার জীবনটা অন্যরকম হয়ে যাবে। তবে আমি কোনো বুদ্ধি আপনাকে দেব না।
কেন?
যে সব স্বামীরা স্ত্রীর বুদ্ধিতে চলে তারা কেমন ভিজা বিড়ালের মতো হয়ে যায়। তাদের দেখলেই মনে হয় দুবলা পাতলা শিং ভাঙা কালো রঙের একটা গরু। গরুর গলায় দড়ি বাধা আছে। তার সামনে কিছু প্রকনা খড়। মাঝে মাঝে সে খড় খাচ্ছে আর করুণ চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আপনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার ক্ষিধে লেগে গেছে। ডিম ভাজাটা দিন আর একটা চামচ দিন। আমি ডিম ভাজা খাব। দেখি আপনার রান্নার হাত কেমন।
ইতি বেশ আয়োজন করে ডিম ভাজা খাচ্ছে। জয়নালের আফসোস হচ্ছে। ইতি ভিম খাবে জানলে এক বোতল টমেটো সস কিনে রাখত। মিষ্টি ছাড়া যে. কোনো জিনিস মেয়েরা সস দিয়ে খায়। জয়নাল বলল, আমি একটা বিপদে পড়েছি। বিপদ থেকে উদ্ধারের কোনো বুদ্ধি কি তোমার কাছে আছে?
ইতি বলল, বিপদটা কী রকম?
আমার চাচা আমার দেশের বসত-বাড়ি দখল করে বসে আছেন। চাচার কাছে আমি একটা চিঠি লিখেছি। চিঠিটা পড়লে বুঝবে।
আপনি পড়ে শোনান। জয়নাল চিঠি বের করে পড়তে শুরু করল।
জনাব মুখলেসুর রহমান,
চাচাজি আমার সালাম নিবেন। কুরিয়ারে পাঠানো আপনার আগের চিঠি পেয়ে আমি খুবই অবাক হয়েছি। আপনি হঠাৎ করে এখন বলছেন যে আমাদের বসত-বাড়ি আপনি নগদ টাকায় বাবার কাছ থেকে কিনেছেন। আপনার কাছে কাগজপত্র আছে। আপনার কাছে খাজনার রশিদও আছে। আপনার কথা পুরোপুরি মিথ্যা। এটা যে মিথ্যা তা আপনি যেমন জানেন, গ্রামবাসীও জানে। বাংলাদেশ মগের মুল্লুক না। এখানে আইন-কানুন আছে। আপনি আমার আপন চাচা, মুরব্বি মানুষ, তারপরেও আমি অবশ্যই থানা পুলিশ করব। ইতিমধ্যে আমি উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করেছি। আদালতে দেওয়ানি মামলা রুজু করার সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। তারপরেও মিটমাটের সুযোগ আছে। বিদেশ যাত্রার আগে আগে আমার টাকা-পয়সা প্রয়োজন। আপনি জমি বিক্রির ব্যবস্থা করে টাকাটা আমাকে দিয়ে দিলে আমার বিরাট উপকার হয়। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য বাঞ্ছনীয় নয়। চাচিকে আমার সশ্রদ্ধ সালাম ও কদমবুসি। অন্যদের শ্রেণীমতো সালাম ও দোয়া।