কলিংবেল বাজছে। রফিকরা গিয়েছে আধঘণ্টাও হয় নি। এত তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে? শামসুদ্দিন দেয়াল ধরে ধরে এগোলেন। দরজা খুললেন। দরজার ওপাশে জয়নাল দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। যেন সে কোনো মানুষ না। প্রেতলোক থেকে ফিরে এসেছে। শামসুদ্দিন বললেন, জয়নাল, তোমার কী হয়েছে?
জয়নাল বিড়বিড় করে বলল, চাচাজি পানি খাব।
ঘরে এসে বসো। পানি এনে দিচ্ছি! তোমার এই অবস্থা কেন? কী হয়েছে।
চাচাজি আমি পাসপোর্টটা হারিয়ে ফেলেছি।
পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেছ?
জি। মানিব্যাগ আর পাসপোর্ট দুটা এক সঙ্গে ছিল। পিক পকেট হয়ে গেছে।
শামসুদ্দিন শান্ত গলায় বললেন, এসো ঘরে এসে বসো। আমি পানি এনে দিচ্ছি। সারা দিন কিছু খাও নি, তাই না?
জয়নাল জবাব দিল না। শামসুদ্দিন হাত ধরে তাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। পানি এনে খাওয়ালেন। তারপর গায়ে হাত রেখে বললেন, তুমি তোমার পাসপোর্টটা আমার কাছে রেখে গেছ। এটা ভুলে গেলে কীভাবে?
জয়নাল এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন সে শামসুদ্দিনের কথা বুঝতে পারছে না। শামসুদ্দিন সুটকেস খুলে পাসপোর্ট বের করে জয়নালের হাতে দিলেন। জয়নাল পাতা উল্টে নিজের ছবি দেখে অজ্ঞান হয়ে চেয়ার থেকে মেঝেতে পড়ে গেল। শামসুদ্দিনের চোখে পানি এসে গেল। তিনি পরপর তিনবার বললেন–আহারে! আহারে! আহারে!
অনেকক্ষণ ধরে দরজার কড়া নড়ছে
অনেকক্ষণ ধরে দরজার কড়া নড়ছে। জয়নাল উঠতে পারছে না। কড়াইয়ে তেল গরম হচ্ছে, ডিমের ওমলেট হবে। কাঁচা তেলে ডিম ঢেলে দিলে তেলের গন্ধ থাকবে। তেল বেশি গরম হয়ে গেলে আবার ধক করে তেলে আগুন জ্বলে উঠবে। এই কড়াইটার হয়তো কোনো সমস্যা আছে। তেল সামান্য গরম হলেই আগুন লেগে যায়।
জয়নাল বলল, কে?
যে কড়া নাড়ছিল সে জবাব দিল না। আরো জোরে কড়া নাড়তে লাগল। মনে হচ্ছে বাড়িওয়ালা কেয়ারটেকারকে পাঠিয়েছে। মাত্র দুমাসের বাড়ি ভাড়া বাকি, ব্যাটার ঘুম হারাম হয়ে গেছে। ঘন্টায় সুন্টায় লোক পাঠাচ্ছে। জয়নাল মনে মনে বলল, দূর কুত্তা। তেল মনে হয় গরম হয়েছে। সে ধীরেসুস্থে ডিম চলল। আজকের ওমলেটটা মনে হয় অসাধারণ হবে, কারণ ডিমে দুই চামচ দুধ দেয়া হয়েছে। ওমলেটটা সোনালি বর্ণ ধারণ করে ফুলে উঠছে।
এখন শুধু যে কড়া নড়ছে তা-না, দরজায় ধাক্কাও পড়ছে। জয়নাল তেমন পাত্তা দিল না। ওমলেট কড়াই থেকে নামিয়ে দরজা খোলার জন্যে রওনা হলো। কেয়ারটেকার ব্যাটাকে কী বলতে হবে মনে মনে ঠিক করে ফেলল। তাকে বলতে হবে – সোমবার সন্ধ্যাবেলায় এসে টাকা নিয়ে যাবেন। পাওনাদারদের নির্দিষ্ট দিনক্ষণ বলে বুঝ দিতে হয়। পরে এসে টাকা নিয়ে যাবেন বললে এরা বুঝ মানে না। নির্দিষ্ট দিনক্ষণ বললে বুঝ মানে।
দরজা খোলার পর জয়নালের মাথা চক্কর দিয়ে উঠল, তার মনে হচ্ছে এক্ষুণি মাথা ঘুরে হুড়মুড় করে সিড়িতে পড়ে যাবে। গড়াতে গড়াতে নেমে যাবে এক তলায়। কড়া নাড়ছে ইতি। ইতি না হয়ে যদি পিঠে ডানা লাগানো সত্যিকার কোনো পরী দেখত তাহলেও এত অবাক হতো না।
ইতি বলল, আপনি কি এই গুহায় বাস করেন? এতক্ষণ ধরে কড়া নাড়ছি দরজা খুলছিলেন না কেন?
জয়নাল বলল, আমরি এই ঠিকানা কোথায় পেয়েছ?
আলম ভাইয়ের কাছ থেকে জোগাড় করেছি। আপনি কি আমাকে দূরজার সামনে দাঁড় করিয়ে রাখবেন না ভেতরে ঢুকতে দেবেন?
এসো, ভিতরে এসো।
দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ান। আমি কি আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকব না-কি?
জয়নাল এক পাশে সরল। তার মাথার চর এখনো ধামে নি। মাথা ঘুরে পড়ে যাবার সম্ভাবনা এখনো আছে। ইতি ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে চারদিক দেখছে।
বেলা সাড়ে এগারোটার সময় ডিম ভাজছেন কেন? এটা আপনার সকালের নাশতা না-কি দুপুরের লাঞ্চ
জয়নাল বলল, ওমলেট খাবে ইতি?
ইতি বলল, কী আশ্চর্য কথা, দুপুর সাড়ে এগারোটার সময় আমি ওমলেট খাব কেন? আপনি আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন না, একটা সার্ট গায়ে দিন। খালি গায়ে ঘুরছেনকুৎসিত লাগছে। লুঙ্গি এত উচু করে পরেছেন কেন? টেংরা টেংরা পা দেখা যাচ্ছে। লুঙ্গি তো আর হাফপ্যান্ট না। লুঙ্গি পরতে হয় লুঙ্গির মতো।
জয়নাল খুবই অস্বস্তির মধ্যে পড়েছে। কী অবস্থা! পরীর চেয়ে দশগুণ সুন্দরী একটা মেয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর সে কিনা খালি গায়ে হাঁটু পর্যন্ত উচু একটা লুঙ্গি পরে হাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছে। লুঙ্গি নামাতে যাওয়াও এখন ঠিক হবে না। হাত যেভাবে কাপছে লুঙ্গির গিট খুলতে গিয়ে অঘটন ঘটে যেতে পারে। আগে লম্বা একটা পাঞ্জাবি পরা দরকার। ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি দুটা থাকার কথা। এখন হয়তো পাঞ্জাবিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। একটা বিপদ যখন আসে তখন সেই বিপদের লেজ ধরে আরেকটা বিপদ আসে। দেখা যাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়িওয়ালা কেয়ারটেকারকে পাঠাবে। সেই কুত্তা কেয়ারটেকার ইতির সামনেই বাড়িভাড়া নিয়ে ঘেউ ঘেউ শুরু করবে।
জয়নাল বলল, দাঁড়িয়ে আছ কেন ইতি, বসো। চা খাবে?
ইতি বসতে বসতে বলল, না।
কোক পেপসি এইসব কিছু খাবে? আনিয়ে দিই?
কিছু আনিয়ে দিতে হবে না। আপনি আমাকে দেখে এত নার্ভাস হয়ে পড়েছেন কেন?
তুমি আসবে ভাবি নি তো।
ইতি বসতে বসতে বলল, আপনার গুহা খুবই অদ্ভুত, কিন্তু সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছেন। সুন্দর একটা পেইন্টিংও দেখি আছে। পেইন্টিংটা কার?
আমার এক বন্ধুর আঁকা। আর্ট কলেজে পড়ত, থার্ড ইয়ারে উঠে পড়া ছেড়ে দিল।