শামসুদ্দিন নিচু গলায় বললেন, টেনশন হচ্ছে?
ছেলেটা অবাক হয়ে তাকাল। মনে হয় অনেক দিন সে এরকম অদ্ভুত প্রশ্ন কারো কাছ থেকে শুনে নি। বোকামি ধরনের প্রশ্নের জবাব দেয়াও অর্থহীন- এ রকম ভঙ্গি করে সে বলল, আপনার সিরিয়েল কত?
তের।
ছেলেটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আপনি খুবই লাকি মানুষ।
কেন?
লাকি নাম্বার পেয়েছেন। অনেকে বলে থার্টিন অনলাকি। আসলে লাকি। কিরোর নিউমারলজি বই-এ আমি নিজে পড়েছি। আপনার সিরিয়েল খার্টিন। তিন আর এক যোগ করলে কত হচ্ছে চার না?
হ্যাঁ চার।
আজকের তারিখটা খেয়াল করেন। বাইশ তারিখ। দুই-এ আর দুই-এ কত হচ্ছে–চার না? সহজ হিসাব। আপনি ইনশাল্লাহ ভিসা পেয়ে যাবেন।
তিনি ভালোমতো ছেলেটাকে লক্ষ করলেন। কপাল কুঁচকে বসে আছে। হাতে নানান ফাইলপত্র। স্থির হয়ে সে যে বসে আছে তাও না। ক্রমাগত নড়াচড়া করছে। তিনি ছেলেটাকে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সিরিয়েল নাম্বার কত?
আমার ফর্টি ওয়ান।
ফর্টি ওয়ান কি লাকি?
আমার জন্যে খুবই অনলাকি। তবে আমেরিকানদের কথা কিছুই বলা যায়। যাদের ভিসা পাওয়ারই কথা না তাদের পাঁচ বছরের মাল্টিপল ভিসা দিয়ে দিচ্ছে। জেনুইনদের রিফিউজ করে দিচ্ছে। আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনি পেয়ে যাবেন।
লাকি নাম্বার, এই জন্যে পাব?
তা না- বুড়োদের এরা ভিসা দিয়ে দেয়। আপনার মুখে দাড়ি নেই, এটা একটা এডভানটেজ। যাদের মুখে চাপদাড়ি এদের ভিসা দেয় না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, এরা লম্বা দাড়ি দেখলেই ভাবে খোমনীর লোক।
খোমেনীর লোক মানে?
ইরানের খোমনীর নাম শোনেন নাই? আপনি তো দেখি গুহামানব। যা হোক বাদ দেন। আপনার নাকে সর্দি। নাক ঝেড়ে আসেন। নাকে সর্দি নিয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে নট কৱে দেবে। পিছনে চলে যান, দেখবেন একটা দরজার গায়ে লেখা রেস্ট রুম। এরা পায়খানাকে বলে রেস্ট রুম।
তুমি কি আগেও এখানে এসেছ?
এটা আমার গার্ড টাইম। এবার না হলে আর হবে না। তবে এবার ইনশাল্লাহ আমার হবে। আজমীরে গিয়েছিলাম, খাজা বাবার দোয়া নিয়ে এসেছি। খাজা বাবার দোয়া নিয়ে যারা ভিসার জন্যে এসেছে সবারই ভিসা হয়েছে। এক হিন্দু ফ্যামিলিকে আমি চিনি। খাজা বাবার দোয়া নিয়ে এসে গুষ্ঠিসুদ্ধ ভিসা পেয়েছে। ইনকুডিং তাদের বাড়ির কাজের বুয়া।
শামসুদ্দিন উঠে দাঁড়ালেন। খুপড়ি ঘর থেকে সুন্দরমতো একটা মেয়ে বের হয়েছে। তিন চার বছরের একটা ফুটফুটে ছেলে তার হাত ধরে আছে। মেয়েটির চোখে পানি। সে শাড়ির আঁচলে যতই চোখ মুছছে ততই পানি বেশি বের হচ্ছে। আর ছেলেটা খুবই অবাক হয়ে মার কান্না দেখছে। শামসুদ্দিন সাহেবের মন খারাপ হয়ে গেল। বুঝাই যাচ্ছে বেচারির মেয়েটির ভিসা হয় নি। হয়তো স্বামী পড়ে আছে আমেরিকায়, সে যেতে পারছে না। ছেলেটি হয়তো তার বাবাকে দেখে নি।
তিনি রেস্ট রুম খুঁজে পাচ্ছেন না। সারি সারি বেশ কিছু ঘর। কোনোটাতেই রেস্টরুম লেখা নেই। বড় দরজার পাশে কালো পোশাক পরা মিলিটারীদের মতো দেখতে একটা লোক বসে আছে। সে তাঁর দিকে কটমট করে তাকাচ্ছে। রেস্টরুম কোন দিকে এই লোককে জিজ্ঞেস করা কি ঠিক হবে? জিজ্ঞেস করতে হবে ইংরেজিতে। দয়া করে বলবেন বাথরুম কোন দিকে?– এর ইংরেজি কী হবে? Kindly show me the Way to the bathroom। ইংরেজি কি ঠিক আছে? বাথরুমের আগে কি The আর্টিকেলটা বসবে?
জিজ্ঞাসা করার আগেই বকের মতো দেখতে ছেলেটা ছুটে এলো। তাকে খুবই উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। সে হড়বড় করে বলল, চাচা মিয়া যান, তাড়াতাড়ি যান। ডাক পড়েছে। ইয়া মুকাদ্দেমু বলে ঘরে ঢুকবেন। কোনো প্রশ্ন করলে জবাব দেবার আগে মনে মনে বলবেন ইয়া মুকাদ্দেমু।
নাক ঝাড়া হলো না তো।
রুমাল নাই? না থাকলে পাঞ্জাবির কোনায় মুছে ফেলেন।
তোমার নাম কী?
আমার নাম দিয়ে এখন দরকার নাই। আগে ইন্টারভ্যু সেরে আসেন। ইয়া মুকাদ্দেমু ইয়া মুকাদ্দেমু বলতে বলতে যান। ইয়া মুকাদ্দেমু আল্লাহর একটা পাক নাম। এর অর্থ হে অগ্রসরকারী। যে-কোনো ইন্টারভ্যুতে এই নাম কাজে আসে।
তাঁর ডাক পড়েছে চার নাম্বার ঘরে। গম্ভীর মুখে আমেরিকান এক সাহেব জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে। তার ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকান সাহেব বলল–হ্যালো। সহজভাবে ভদ্র ভঙ্গিতে বলল।
শামসুদ্দিন থতমত খেয়ে গেলেন। সাধারণত টেলিফোনেই হ্যালো বলা হয়। মুখোমুখি কারো সঙ্গে দেখা হলেও কি হালো বলা হয়? এর উত্তরে কি তাকেও হ্যালো বলতে হবে? নাকি তিনি বলবেন গুড মর্নিং? বারটা বেজে থাকলে তো গুড মর্নিং বলা যাবে না। বলতে হবে গুড আফটারনুন।
তিনি কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। পর পর চারবার হাঁচি দিলেন। সাহেবটা বলল, ব্লেস ইউ। শামসুদ্দিন আরো হকচকিয়ে গেলেন। তাঁকে পুরোপুরি বিস্মিত করে দিয়ে আমেরিকান সাহেব সুন্দর বাংলায় বলল–আপনার ফার্স্ট নাম শামসুদ্দিন? পারিবারিক নাম আহমেদ?
তিনি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।
আমেরিকা যেতে চান কেন?
বেড়াতে যাব স্যার।
কথাটা মিথ্যা বলা হলো। তিনি দরিদ্র মানুষ। তার মতো দরিদ্র মানুষরা বেড়াতে যায় না। আর গেলেও তাদের দৌড় কক্সবাজার পর্যন্ত। আমেরিকায় যাবার পেছনে তার তুচ্ছ একটা কারণ আছে। তিনি একজনের সঙ্গে দেখা করতে চান। দুই মিনিটের জন্যে দেখা হলেও হবে। তুচ্ছ কারণটা কি সাহেবকে বলা ঠিক হবে?
আপনি কী করেন?
শিক্ষকতা করতাম। সম্প্রতি অবসর নিয়েছি। প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা পেয়েছি। আগের কিছু সঞ্চয় আছে। আমার এক ছাত্র আছে ট্রাভেলিং এজেন্সিতে কাজ করে। সে সস্তায় টিকিট কিনে দেবে।