ভাইজান, আমি বুঝতে পারছি না।
আমি কি বিষয়টা নিয়ে রাহেলার সঙ্গে কথা বলব?
এটাও তো বুঝতে পারছি না।
পৃথুর কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। রফিক উঠে শোবার ঘরের দিকে রওনা হলো। শামসুদ্দিন সিগারেট হাতে মূর্তির মতো বসে রইলেন। তার কাছে মনে হলো তার চারপাশের ঘর-বাড়ি দুলছে। ভূমিকম্প হচ্ছে। এক্ষুণি মাথার উপরের ছাদ ভেঙে নিচে নেমে আসছে।
শোবার ঘরে পৃথু মুখে হাত চাপা দিয়ে দাড়িয়ে আছে। সে হাত চাপা দিয়ে কান্না থামাবার চেষ্টা করছে। থামাতে পারছে না। হাতের ফাক দিয়ে চাপা কান্না বের হয়ে আসছে। রাহেলা ছেলের সামনে দাড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি কঠিন। তার এক হাতে মাছ কাটার বটি। পৃথু এক একবার কেঁদে উঠছে, রাহেলা সঙ্গে সঙ্গে বলছে–খবরদার! শব্দ বের হলে বটি দিয়ে গলা কেটে দুটুকরা করে ফেলব। খবরদার!
রফিক ঘরে ঢুকে বলল, কী হয়েছে?
রাহেলা বলল, তোমাকে বলার মতো কিছু হয় নি।
রফিক বলল, বুটিটা আমার হাতে দাও। প্লিজ দাও। পৃথু ভয় পাচ্ছে। বটিটা দাও।
রাহেলা বটি মাটিতে ফেলে দিয়ে বলল, আমাকে একটা বেবিটেক্সি ডেকে দাও। আমি তোমাদের সঙ্গে থাকব না।
রাতের বেলা কোথায় যাবে?
কোথায় যাব এটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।
রফিক বলল, রাতটা থাক। সকাল হোক, তুমি যেখানে যেতে চাও আমি দিয়ে আসব।
রাহেলা বলল, ভাইজানের সঙ্গে এতক্ষণ ধরে শুইট করে কী কথা বলেছ?
উনি আমেরিকা কবে যাবেন, টিকিট হয়েছে কিনা এইসব জিজ্ঞেস করছিলাম।
রাহেলা, একসপ্রেসো কফি খাবে? মোড়ে একটা নতুন ফাস্ট ফুডের দোকান হয়েছে, তারা খুব ভালো একসপ্রেসো কফি বানায়। এক কাপ দশ টাকা। খাবে?
রাহেলা কিছু বলল না। রফিক উৎসাহের সঙ্গে বলল, নিয়ে আসি এক কাপ কফি। ভালো না লাগলে ফেলে দিও। পৃথু ব্যাটা, কফি খাবি নাকি?
পৃথু চোখ মুছতে মুছতে বলল, খাব।
তাহলে চল তোকে কফি খাইয়ে আনি আর তোর মার জন্যে কফি নিয়ে আসি। তার আগে একটা কাজ কর বাবা, যা হাত মুখ ধুয়ে আয়। সার্ট পর। জুতা পায়ে দে। তুই কি নিজে নিজে জুতার ফিতা বাঁধতে পারিস?
পারি।
ভেরি গুড। আমার সামনে জুতার ফিতা বাঁধ। ফিতা বাঁধা পরীক্ষা হবে।
পৃথু হেসে ফেলে বাথরুমের দিকে রওনা হলো। একটু আগেই পরিস্থিতি কী ভয়ঙ্কর ছিল। তার মা আরেকটু হলে বটি দিয়ে তাকে কেটেই ফেলত। বাবা এসে ফু মন্ত্র দিয়ে সব ঠিক করে দিল। বাবার মধ্যে পাওয়ার আছে। সুপারম্যান, স্পাইডারম্যানের মতো পাওয়ার। তবে বাবার পাওয়ারটা দেখা যায় না।
রাহেলা খাটে এসে বসেছে। তাকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে। রফিক বলল, শরীরটা কি খারাপ লাগছে?
রাহেলা বলল, সামান্য খারাপ লাগছে।
রফিক বলল, রেস্ট নাও। ঠিক হয়ে যাবে।
রাহেলা বলল, ভাইজান হঠাৎ করে আমেরিকা যাবার জন্যে কেন পাগল হয়েছে এটা আমি চিন্তা করে বের করে ফেলেছি।
কেন আমেরিকা যাচ্ছেন?
বীথির সঙ্গে দেখা করার জন্যে।
বীথিটা কে?
ভাইজান এক সময় ব্যাংকে চাকরি করত। বীথি নামের একটা মেয়ে ছিল তাঁর কলিগ। ভাইজানের সঙ্গে বীথির বিয়ে ঠিক হলো। বরযাত্রী নিয়ে ভাইজান বিয়ে করতে গেল নরসিংদি। আমিও ছিলাম বরযাত্রীর দলে। মওলানা এসে বিয়ে পড়াতে গেল। মেয়ে বলল, না। আমি রাজি না! কবুল বলব না।
কেন?
কেন আমি জানি না। কেউ জানে না। ভাইজান ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে নানান দুঃখধন্ধের মধ্যে পড়ল। শেষমেষ একটা স্কুল মাস্টারি জোগাড় করল। সারা জীবন বিয়ে করল না।
বীথি মেয়েটা আমেরিকায় থাকে?
হ্যাঁ। বিয়ে করে অনেক দিন আগে চলে গেছে। শোন, যেভাবেই হোক ভাইজানের যাওয়া আটকাতে হবে। তাঁকে ঐ মেয়ের সঙ্গে কিছুতেই দেখা করতে দেওয়া হবে না।
অবশ্যই। রাহেলা চাপা গলায় বলল, ভাইজান আলাভোলা মানুষ। যখন তখন অসুখবিসুখ বাধায়। ভাইজানকে তো আমি কিছুতেই বিদেশের মাটিতে ছাড়ব না।
তাকে ছাড়া উচিতও হবে না।
বাচ্চা হবার সময় আমি বাঁচি না মরি তার মাই ঠিক। তখন যদি ভাইজান কাছে না থাকে তার সঙ্গে তো আমার দেখাই হবে না।
ঐ দিকটা আমি চিন্তা করি নি। আসলেই তো তোমার বাচ্চা হবার আগে কিছুতেই তাকে যেতে দেয়া হবে না। তুমি নিশ্চিত থাক।
পৃথু জুতা পরে এসেছে। সে বাবার সামনে জুতার ফিতা বাঁধার পরীক্ষা দিয়ে বাঁ পায়ের জুতায় ফেল করল। ডান পায়ের জুতায় পাশ করল। রফিক বলল, তুই একশতে পঞ্চাশ পেয়েছিস। এটা খারাপ না। ত্রিশ হলো পাস মার্ক। পাস মার্কের চেয়েও বিশ বেশি পেয়েছিস। চল এবার কফি খেয়ে আসি। রাহেলা তুমিও চল। হাঁটতে হাঁটতে যাই। কাছেই তো।
রাহেলা সঙ্গে সঙ্গে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াল। রফিক বলল, এক কাজ করলে কেমন হয়–পৃথু যেহেতু কঠিন একটা পরীক্ষায় ফিফটি পার্সেন্ট মার্ক পেয়েছে সেই উপলক্ষে চাইনিজ খেয়ে ফেললে কেমন হয়? অনেকদিন বাইরে খাওয়া হয় না।
পৃথু বলল, খুব ভালো হয় বাবা।
রাহেলা বলল, ভাইজানকে নিয়ে চল। তাকে ফেলে রেখে আমি চাইনিজ খেতে যাব না।
রফিক বলল, কী বলো তুমি তাকে রেখে যাব না-কি? অবশ্যই তাকে নিয়ে যাব।
শামসুদ্দিন কিছুতেই বাইরে যেতে রাজি হলেন না। শেষে ঠিক হলো তাঁর জন্যে খাবার নিয়ে আসা হবে।
শামসুদ্দিন বাতি নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছেন। হঠাৎ করেই তার শরীর খারাপ করেছে। মাথার দুলুনি প্রবল হয়েছে। বিছানায় শুয়ে থাকলে কম দোলে। উঠে বসলেই চারপাশের জগৎ দুলতে থাকে। মনে হয় তিনি নৌকায় বসে আছেন। নদীতে প্রবল ঢেউ উঠেছে। নৌকা দুলছে। নৌকার সঙ্গে তিনিও দুলছেন।