বেলা দুটা নাগাদ জয়নাল নিশ্চিত হলো তার মানিব্যাগ এবং পাসপোর্ট দুটাই পকেটমার হয়েছে। দুটা থেকে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত সে এক নাগাড়ে রাস্তায় হাঁটুল। উদ্ভ্রান্ত মানুষের হাঁটা। মাথায় কোনো চিন্তা নেই, কোনো উদ্দেশ্য নেই, শুধুই হাঁটা। ফার্মগেটের ওভারব্রিজে উঠে একবার তার মনে হলো, চিৎকার করে বলে আমার দিকে তাকিয়ে দেখুন। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে দেখুন। কেন এ ধরনের চিন্তা মাথায় এলে তাও সে জানে না। সে ওভারব্রিজের রেলিং-এ হাত রেখে ঝুঁকে নিচের দিকে তাকাচ্ছে রাস্তা ভর্তি লোকজন, গাড়ি, ট্রাক, বাস। সবাই কত ব্যস্ত, একমাত্র তার কোনো ব্যস্ততা নেই। সন্ধ্যা না মিলানো পর্যন্ত সে ফার্মগেট ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে রইল।
শামসুদ্দিন কিছুক্ষণ আগে মাগরেবের নামাজ শেষ করেছেন। ফরজের পর দুরাকাত সুন্নত পড়বেন এই সময় ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। ঘর নিকষ অন্ধকার হয়ে গেল। পুরোপুরি অন্ধকার ঘরে না-কি নামাজ পড়তে নেই। সামান্য আলো হলেও নাকি থাকতে হবে। শামসুদ্দিন জায়নামাজে বসে রইলেন। ঘরের পরিস্থিতি আজ ভয়াবহ। কিছুক্ষণ আগেও থালা বাসন ভাঙার শব্দ আসছিল। রাহেলী কিছুদিন হলো রাগ দেখানোর নতুন পদ্ধতি হিসেবে থালা বাসন ছুড়ে ছুড়ে মারছে। কোনো একদিন বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। শামসুদ্দিন ঠিক করলেন–আজ রাতে কোনো এক সময় তিনি রাহেলার সঙ্গে কথা বলবেন। শান্তভাবে বোঝানোর চেষ্টা করবেন। রফিকের সঙ্গে কথা বলে আসিয়া মেয়েটাকে বিদায় করার চেষ্টা করবেন।
মোমবাতি জ্বালিয়ে রফিক ঘরে ঢুকল। টেবিলের উপর মোমবাতি বসাতে বসতে বলল, ভাইজানের নামাজ শেষ হয়েছে?
দুরাকাত সুন্নত বাকি আছে।
নামাজ শেষ করুন। আমি চা নিয়ে আসছি। আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে। ভাইজান।
শামসুদ্দিন নামাজ শেষ করলেন কিন্তু বুঝতে পারলেন নামাজ হয় নি। তিনি নামাজে মন দিতে পারেন নি। আত্তাহিয়্যাতু সূরায় দুবার গণ্ডগোল হলো। গোড়া থেকে পড়তে হলো। ঘরের ভেতর থেকে রাহেলার ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ফোপানোর সঙ্গে সঙ্গে সে বলছে–তুমি অমির গায়ে হাত তুললে? তুমি এতটা নিচে নমিলে? শামসুদ্দিনের মন খুবই খারাপ হয়েছে। গর্ভবতী কোনো স্ত্রীর গায়ে স্বামী হাত তুলতে পারে? কী অসম্ভব ব্যাপার!
রফিক চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। এক কাপ চা, এক বাটি তেল মরিচ দিয়ে মাখা মুড়ি। শামসুদ্দিন চায়ের কাপ হাতে নিলেন রফিক বলল, ভাইজান, আপনি এত মন খারাপ করে থাকবেন না। আমি রাহেলার গায়ে হাত তুলি নি। এই কাজটা আমার পক্ষে করা সম্ভব না। আমি শুধু বলেছি–এক থাপ্পর লাগাবো। এতেই সে আউলায়ে গেছে। এই কথাটাও আমার বলা উচিত হয় নি। কী করব ভাইজান বলুন, আমি রাগটা সামলাতে পারি নি।
শামসুদ্দীন ক্ষীণ গলায় বললেন, একজন অসুস্থ মানুষ এটা তো রফিক তোমার মাথায় রাখতে হবে।
রফিক হতাশ গলায় বলল, ভাইজান আমি এটা মনে রাখি কিন্তু আমারো তো ধৈর্যের সীমা আছে। আমি তো রোবট না। আমি মানুষ। নিজে নানা সমস্যার মধ্যে থাকি। ব্যবসায়িক অবস্থা খারাপ। সংসার টানতে না পারার লজ্জায় ছোট হয়ে থাকি। এর মধ্যে যদি…
কথা শেষ না করে রফিক সিগারেট ধরাল। শামসুদ্দিন বললেন, সমস্যাটা কি আসিয়া নামের কাজের মেয়েটাকে নিয়ে। তাকে নিয়ে সমস্যা হলে মেয়েটাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে আনলে হয়।
রফিক অবাক হয়ে বলল, আসিয়াকে নিয়ে কী সমস্যা?
শামসুদ্দিন চুপ করে গেলেন। তার কাছে মনে হলো প্রসঙ্গটা তোলাই উচিত হয় নি। রফিক ব্ৰিত গলায় বলল, সমস্যাটা ভাইজান আপনাকে নিয়ে।
শামসুদ্দিন হতভম্ব হয়ে তাকালেন। চা গলায় আটকে বিষম খাওয়ার মতো হলো। রফিক বলল, যে রাতে আপনি জ্বর নিয়ে বাসায় ফিরলেন সেই রাতের ঘটনা। আপনার অবস্থা দেখে রাহেলা শুরু করল কান্না। মরা কান্না বলে যে কথা আছে সেই কান্না। আমি এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বললাম, ভাইজানের জ্বর এসেছে। এমন কোনো সিরিয়াস ব্যাপার তো না। তুমি মরা কান্না শুরু করেছ কেন? এখন তো আশেপাশের ফ্ল্যাট থেকে লোকজন ছুটে আসবে। তখন সে রেগে গিয়ে বলল, কেন কাদছি শুনবে? আমি ভাইজান ডাকলেও উনি আমার ভাই না। তার সঙ্গে ছোটবেলায় আমার বিয়ে হয়েছিল। আমার মা গোপনে মৌলানা ডাকিয়ে কবুল পড়িয়ে আমাদের বিয়ে দিয়েছিলেন। এখন বুঝতে পারছ কেন চিঙ্কার করে কাদছি?
শামসুদ্দিন চায়ের কাপ নামিয়ে রাখলেন। রফিক নিচু গলায় বলল, ভাইজান, আমি জানি কথাগুলি মিথ্যা। এই নিয়ে আমার মনে কোনো রকম সন্দেহ নাই। রাহেলা অসুস্থ। আপনাকে সে খুবই পছন্দ করে। মানসিক অসুস্থতা, অতিরিক্ত পছন্দ সব মিলিয়ে পুরো ব্যাপারটা রাহেলার মাথায় জট পাকিয়ে গেছে। ভাইজান, আপনি এইভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আমার খুব খারাপ লাগছে। নেন, একটা সিগারেট নেন।
শামসুদ্দিন হাত বাড়িয়ে সিগারেট নিলেন। সিগারেট ধরাতে গিয়ে দেখলেন তিনি সিগারেট ধরাতে পারছেন না। তাঁর হাত কাঁপছে। রফিক বলল, ভাইজান, আমি খুব লজ্জিত যে আপনাকে এত বড় অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছি। রাহেলা এতটা অসুস্থ ছিল না। আপনি আমেরিকা যাবেন এটা শোনার পর থেকে সে পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমি যে কী বিপদে পড়েছি–এক আল্লাহপাক জানেন। আর কেউ জানে না।
আমি যদি অন্য কোথাও চলে যাই তাতে কি সুবিধে হবে?