উৎসাহজনক কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না–তাতে জয়নাল মোটেই চিন্তিত না। নেত্রকোনায় তাদের যে বসতবাড়ি আছে সেটা জরুরি ভিত্তিতে বিক্রি করার জন্যে সে তার বড় চাচাকে চিঠি দিয়েছে এবং টেলিগ্রাম করেছে। দশ কাঠা জমির উপর বাড়ি। কাঠাল বাগান আছে, আম বাগান আছে। বাড়ির পেছনে ছোট পুকুর আছে। খুব কম করে হলেও জমির দাম পাঁচ লাখ টাকা হওয়া উচিত। পানির দামে বিক্রি করলেও দু লাখ টাকা আসবে। পৈতৃক ভিটা বিক্রি করলে বাবা-মার অভিশাপ লাগে এই ভেবে এত অভাবেও বিক্রির চিন্তা মাথায় আসে নি। এখন বাধ্য হয় চিন্তা করতে হচ্ছে। তাছাড়া জয়নালের ধারণা আমেরিকার মতো দূর দেশে অভিশাপ পেঁৗছবে না। সে ঠিক করে রেখেছে বাড়ি বিক্রির টাকাটা চলে এলে এখানকার সমস্ত ঋণ শোধ করবে। খাসি জবেহ করে বন্ধু-বান্ধবদের একটা পার্টি দেবে। তার বিয়েটা যদি হয়েই যায় সেখানেও কিছু খরচ আছে। হাজার বিশেক টাকা ইতির হাতে ধরিয়ে দিয়ে যেতে হবে। বিয়ের পরেও মেয়ে বাবা-মার হাত থেকে খরচ নেবে সেটা তো হয় না। তবে ইতির যা খরচের হাত মনে হচ্ছে এক সপ্তাহের মধ্যেই টাকা উড়িয়ে দেবে। এরও একটা ভালো দিক আছে–যে সব স্ত্রী খরুচে তাদের স্বামীরা ভালো রোজগার করে। কৃপণ স্ত্রীদের স্বামীরা আয় উন্নতি করতে পারে না। শাস্ত্রের কথা।
জয়নালের বিয়ের ব্যাপারটা কিছু অগ্রগতি হয়েছে। শামসুদ্দিন প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন। মেয়েপক্ষ হ্যাঁ না বললেও সরাসরি নাও বলে নি। মেয়ের এক ফুপা অবশ্যি বলেছেন বাপ-মা নেই ছেলে। এটা একটা সমস্যা। মেয়ে কোনোদিন শ্বশুরশাশুড়ির আদর পাবে না।
মেয়ের ফুপা বললেন, এতিম ছেলে দুর্ভাগ্যবান হয়।
শামসুদ্দিন বলেছেন, খুবই ভুল কথা বললেন। আমাদের নবী এ করিম সাল্লালাহু আলায়ে সালাম ছিলেন এতিম। তিনি কি দুর্ভাগ্যবান?
জয়নাল শামসুদ্দিন সাহেবের কথাবার্তায় মুগ্ধ। আলাভোলা টাইপের এই লোক যে এত গুছিয়ে কথা বলবে এটা ভাবাই যায় না। মেয়ের বাবা যখন বললেন, আপনি কি ছেলের আপন চাচা? তখন শামসুদ্দিন সাহেবের জবাব দেবার আগেই জয়নাল বলেছে, জি আপন চাচা। উনিও আমার সঙ্গে আমেরিকা যাচ্ছেন। ভিসা পেয়ে গেছেন। উনি যাচ্ছেন বেড়াতে। উনার আবার দেশ-বিদেশ ঘুরার শখ। অনেক দেশ ঘুরেছেন। আমেরিকাটা বাকি আছে। ইনশাল্লাহ এইবার আমেরিকাও দেখবেন।
মেয়ের বাবা অবাক হয়ে বললেন, বেড়াবার জন্যে আমেরিকা যাচ্ছেন? শামসুদ্দিন সাহেব এবারও জবাব দেবার সুযোগ পেলেন না। জয়নাল তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আমেরিকার ভেলেভু হাসপাতালে উনি জেনারেল চেকআপ করবেন, তাঁর স্বাস্থ্যটা ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। হাঁচির সমস্যা হচ্ছে। দেশে ট্রিটমেন্টের যে অবস্থা!
পাত্রীপক্ষ হ্যাঁ না বললেও জয়নাল প্রায় সত্ত্বর ভাগ নিশ্চিত যে বিয়েটা হয়ে যাবে। সে স্বপ্নে দেখেছে তার বিয়ে হচ্ছে। নৌকায় করে বরযাত্রী যাচ্ছে। বরযাত্রীর মধ্যে তার বাবাও আছে। সে বাবাকে দেখে অবাক হয়ে বলল, আপনি না মারা গেছেন। আপনি এখানে আসলেন কীভাবে? জয়নালের কথায় বিরক্ত হয়ে তার বাবা বললেন, তুই ছোটবেলায় যেমন গাধা ছিলি এখনো দেখি সেরকম গাধাই আছিস। মারা গিয়েছি বলে ছেলের বিয়েতে বরযাত্রী আসব না? এ ধরনের স্বপ্ন দেখার একটাই মানে বিয়ে হবে। বিয়ের জন্যে তৈরি হয়ে যাওয়া উচিত। আংটি কিনতে হবে, শাড়ি কিনতে হবে। বিয়ের পর একদিনের জন্যে হলেও কনেকে স্বামীর বাড়ি যেতে হয়। স্বামীর বাড়িটা কোথায় যে সে যাবে? ইতিকে নিয়ে সে নিশ্চয়ই গ্যারেজের উপরের ঘরে উঠতে পারে না।
সোমবার জয়নালের জন্যে খুব ভালো দিন। তার জীবনে ভালো কিছু ঘটে নি। তারপরেও যা কিছু শুভ তা ঘটেছে সোমবারে। সর্বশেষ আমেরিকান ভিসা এটাও সোমবারে পাওয়া। সোমবার শুধু মাত্র এই কারণে জয়নালের মন ভালো থাকে। ঘুম ভাঙার পর মনে হয়, আহ কী শুভ দিন!
আজ সোমবার। জয়নাল ঠিক করে রেখেছে নিউ মার্কেট থেকে টাটকা একটা চিতল মাছ কিনে ইতিদের বাসায় দিয়ে আসবে। তাকে বলবে তার এক বন্ধুর হাওরে জলমহাল আছে। সেখান থেকে মাছ পাঠিয়েছে। সে একা মানুষ, এত বড় মাছ দিয়ে কী করবে? কাজেই মাছটা দিয়ে গেল। নিজের বুদ্ধিতে জয়নাল নিজেই মুগ্ধ এবং আনন্দিত হলো। আনন্দ স্থায়ী হলো না সোমবার শুভদিনে তার জন্যে এক দুঃসংবাদ এসে উপস্থিত হলো। মেজো চাচা দেশ থেকে কুরিয়ার সার্ভিসে চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে লেখা–
বাবা জয়নাল,
দোয়াগো
তোমার চিঠি এবং টেলিগ্রাম যথা সময়ে পাইয়াছি। চিঠি এবং টেলিগ্রাম পড়িয়া যারপরনাই বিস্মিত হইলাম। ঘটনা কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। তোমাদের বসত বাড়ি বড় ভাইজান জীবিত থাকা অবস্থাতেই উনার নিকট হইতে আমি খরিদ করি।
এই জমির খাজনা আমি নিজের নামে পরিশোধ করিতেছি। তারপরও তোমার মনে যদি কোনো সন্দেহ থাকে তাহা হইলে খাজনা পরিশোধ রসিদ দেখিয়া যাইতে পার।
তুমি আমেরিকা যাইতেছু শুনিয়া আমি এবং তোমার চাচি দুইজনেই অত্যন্ত খুশি হইয়াছি। দোয়া করি আল্লাহ তোমাকে সুখী করুন। আমেরিকা রওনা হইবার পূর্বে অতি অবশ্যই তুমি দেশের বাড়িতে বেড়াইয়া যাইব।
ইতি
তোমার চাচা
ইদরিস আলী
খারাপ সংবাদের নিয়ম হলো, একটা খারাপ সংবাদের পর পর দ্বিতীয় খারাপ সংবাদটা আসে। খারাপ সংবাদ কখনো একা আসতে পারে না। জয়নালের ক্ষেত্রেও তাই হলো–চাচার চিঠি পড়ে হতভম্ব ভাবটা দূর হবার আগেই দোকানে সিগারেটের দাম দিতে গিয়ে লক্ষ করল কোটের পকেটে মানিব্যাগ নেই। জয়নালের মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। কারণ মানিব্যাগের সঙ্গেই তার পাসপোর্ট। মানিব্যাগের সঙ্গে পাসপোর্টও নেই। এমন কি হতে পারে সে বাসায় পাসপোর্ট এবং মানিব্যাগ রেখে এসেছে? হে আল্লাহ পাক তাই যেন হয়। যদি তাই হয় আমি এক হাজার রাকাত শুকরানা নামাজ পড়ব।