কেন?
শাহজালাল সাহেবের দোয়া নিতে হবে না? তার উপর খুবই খারাপ একটা স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্ন কাটান দিতে হবে।
কী স্বপ্ন দেখেছ?
দেখেছি আমি আর আপনি এয়ারপোর্টে স্যুটকেস ব্যাগ নিয়ে দাড়িয়ে আছি। ইমিগ্রেশন আপনাকে ছেড়ে দিয়েছে কিন্তু আমাকে আটকে দিয়েছে। নানানভাবে চেকিং করছে। তারপর দেখি চেকিং করার নামে আমার সব কাপড় খুলে ফেলেছে। আমি পাসপোর্ট হাতে নিয়ে পুরো নেংটো হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। দুনিয়ার লোকজন আমাকে দেখছে আর মুখ টিপে হাসছে। এত ভয়ঙ্কর স্বপ্ন আমি গত দশ বছর দেখি নি। স্বপ্নটা দেখার পরে আমার মনের মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে। হয়তো দেখা যাবে আমাকে আটকে দিয়ে, আপনি ডেং ডেং করে প্লেনে উঠে যাবেন।
শামসুদ্দিন বললেন, শোন জয়নাল, তোমাকে রেখে আমি আমেরিকা যাব না।
থ্যাংক য়্যু। আমিও আপনাকে ফেলে যাব না। মনটা শান্ত করার জন্যে শুধু শাহজালাল সাহেবের দরগী থেকে ঘুরে আসতে হবে। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমেরিকা চলে যেতে হবে। দেরি করা যাবে না। আমেরিকানদের ভাবভঙ্গি তো বোঝা মুশকিল হঠাৎ হয়তো নোটিশ দিয়ে দিল ভিসা হবার তিন মাসের মধ্যে আমেরিকা না গেলে ভিসা ক্যানসেল।
শামসুদ্দিন উঠে বসলেন। জয়নাল বলল, এখন একটু ভালো বোধ করছেন না? মেডিসিন কাজ করা শুরু করেছে। হোমিওপ্যাথির ট্যাবলেট ছোট ছোট, কিন্তু অ্যাকশানে মারাত্মক।
শামসুদ্দিনের মনে হলো আসলেই তার শরীরটা ভালো লাগছে। তার ইচ্ছা করছে জয়নালের সঙ্গে বের হয়ে যেতে। এ বাড়ির সমস্যাগুলি খুবই জটিল হতে শুরু করেছে। রাহেলা সত্যি সত্যি আবারো চলে গেছে। যেখানেই যাক রাতে নিশ্চয়ই ফিরবে। তখন রফিকের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া শুরু হবে। পৃথু অকারণে মার খাবে। এর মধ্যে থাকতে ইচ্ছা করছে না। একেবারেই ইচ্ছা করছে না।
টিম্বার মার্চেন্ট এস আলম অ্যান্ড সন্স
টিম্বার মার্চেন্ট এস আলম অ্যান্ড সন্স এর অফিসে তিনঘণ্টা দশ মিনিট ধরে জয়নাল বসে আছে। এস আলম সাহেবের সঙ্গে জয়নালের দেখা হয়েছে। জয়নাল তাকে খুব সুন্দর করে বুঝিয়েছে যে তার কিছু টাকা দরকার। সাহায্য না, ঋণ! ছমাসের জন্য সুদমুক্ত ঋণ। আমেরিকায় যাবার টিকিট কেনার জন্যে টাকাটা দরকার। একজনের কাছ থেকে সে পুরো টাকা নেবে তা না। অনেকের কাছ থেকে নেবে এবং ছ মাসের মধ্যে পুরোটা ফেরত পাঠাবে।
এস আলম সাহেব যে জয়নালের অপরিচিত তা না। মুখ চেনা পরিচয় আছে। তিনি জয়নালের বন্ধু সিদ্দিকের খালু। সিদ্দিকের ভাষায় তার এই খালু টাকার কুমীর না, টাকার তিমি মাছ।
ভদ্রলোক জয়নালের কথা মন দিয়ে শুনলেন তারপর বললেন, অপেক্ষা কর। জয়নাল অপেক্ষা শুরু করেছে। অপেক্ষায় অপেক্ষায় তিন ঘণ্টা দশ মিনিট পার হয়ে গেছে। অফিসে চা-এর ব্যবস্থা আছে। ধবধবে ফর্সা, রোগী টিং টিংএ একটা ছেলে তার নাম কান্ন, সে চাওয়া মাত্র চা দিয়ে যাচ্ছে। তিন ঘন্টা দশ মিনিটে জয়নাল এগারো কাপ চা খেয়ে ফেলল, সেই সঙ্গে পাঁচটা নোনতা বিসকিট। এক সময় দেখা গেল এস আলম সাহেব অফিস শেষ করে বাড়ির দিকে রওনা হবার জন্যে বের হলেন। গাড়ি আনতে বললেন। জয়নাল বিস্মিত হয়ে এগিয়ে গিয়ে বলল, স্যার আমার ব্যাপারটা।
এস আলম সাহেব পাঞ্জাবির পকেট থেকে পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করে জয়নালের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, নিয়ে যাও। এটা ফেরত দিতে হবে না।
জয়নাল বলল, সরি আমি পাঁচশ টাকার জন্যে আপনার কাছে আসি নি।
এস আলম সাহেব পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন, ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ। নিলে নাও, না নিলে নাই।
জয়ললি বলল, থাক লাগবে না।
এস আলম সাহেব সঙ্গে সঙ্গে টাকা মানিব্যাগে ঢুকিয়ে গাড়ির দিকে রওনা হলেন। জয়নাল মনে মনে বলল–যা কুত্তা।
টিকিটের টাকা জোগাড়ের জন্যে জয়নাল একচল্লিশ জনের একটা তালিকা করেছে। একচল্লিশ জনের মধ্যে তার আত্মীয়স্বজন আছে, বন্ধু-বান্ধব আছে, বন্ধু-বান্ধবের আত্মীয়স্বজন আছে। গত পাঁচ বছরে জয়নাল যে সব ছাত্র-ছাত্রীকে পড়িয়েছে তাদের বাবা-মা আছে। টাকা সংগ্রহ অভিযান যেমন হবে ভাবা। গিয়েছিল তেমন মনে হচ্ছে না। সবাই টিম্বার মার্চেন্ট এস আলমের মতো আচরণ করছে। জয়নালের কয়েকজন ছাত্রের বাবা-মা জয়নালকে চিনতেই পারল না। একজন ছাত্রের মা বলল, আপনি মিঠুকে পড়িয়েছেন? কবে? আশ্চর্য কথা! মিঠু কখনো প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়েছে বলে তো মনে হয় না। আপনার কথাবার্তা খুবই সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। আপনি চলে যাবেন না। মিঠু স্কুল থেকে ফিরুক। আপনাকে আইডেনটিফাই করুক, তারপর যাবে যদি আপনাকে আইডেনটিফাই করতে না পারে তাহলে আমি কিন্তু আপনাকে পুলিশের কাছে হ্যান্ডওভার করে দেব।
জয়নাল চোখ মুখ শুকনা করে ড্রয়িংরুমে বসে মিঠুর আগমনের প্রতীক্ষা করতে লাগল। তার একটা ভয় মিঠু যদি তাকে চিনতে না পারে তাহলে কী হবে! ভিক্ষা চাই না মা কুত্তা সামলাও অবস্থা। মিঠু ফিরল বিকেল পাঁচটায়। সে জয়নালকে দেখেই বলল, স্যার কেমন আছেন? আপনার মাথার সব চুল পড়ে গেছে কেন?
মিঠুর মা বললেন, সরি আপনাকে এতক্ষণ বসিয়ে রেখেছি। আপনি কিছু মনে করবেন না। বাধ্য হয়ে প্রিকশান নিতে হয়েছে। ঢাকা শহর জুয়াচোরে ভর্তি হয়ে গেছে। কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। যাই হোক, আপনাকে আমরা কোনো সাহায্য করতে পারব না। আমাদের নিজেদেরই অর্থনৈতিক ক্রাইসিস যাচ্ছে। জয়নাল সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মনে মনে বলল–দূর মোটা কুত্তি।