তুই কখন এসেছিস?
ঘড়ি দেখি নাই। দুটা হবে। এসে দেখি স্যুট পরা কোনো এক বাবু সাহেব তোমার মাথায় পানি ঢালছে।
কে, জয়নাল?
নাম জিজ্ঞেস করি নাই। তাকে পাঠিয়েছি ডাক্তার আনতে। ভাইজান, সত্যি করে বলো তো এখন কি একটু ভালো লাগছে?
রাহেলার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে শামসুদ্দিন বললেন, যে পানি ঢালছিল তার মাথায় কি টাক?
এত কিছু লক্ষ করি নি ভাইজান। আমি বাঁচি না নিজের যন্ত্রণায়। আমি বসে বসে দেখব কার মাথায় টাক কার মাথায় চুল? সে তো ডাক্তার নিয়ে আসবেই তখন দেখে তার মাথা ভর্তি চুল না টাক।
রফিক কোথায়?
আমি জানি না কোথায়। একটার সময় এসে ছেলের হাতে এক প্যাকেট বিরিয়ানি ধরিয়ে দিয়ে চলে গেছে।
মাথায় আর পানি দিস না। ঠাণ্ডা লাগছে।
লাগুক ঠাণ্ডা, ডাক্তার না আসা পর্যন্ত আমি পানি দিতেই থাকব। ভাইজান, তুমি সুস্থ হয়ে উঠ। তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে। আমি বাসায় ফিরতাম না, শুধু তোমাকে জরুরি কথা বলার জন্যেই ফিরেছি। এসে দেখি তোমার এখন যায় তখন যায় অবস্থা। ডাক্তার এসে তোমাকে দেখে যাক, তারপর তোমাকে জরুরি কথাগুলো বলে চলে যাব।
কোথায় চলে যাবি? তোর কি থাকার জায়গা আছে?
জায়গা না থাকলেও চলে যাব। প্রয়োজনে খারাপ পাড়ায় গিয়ে বাড়িওয়ালীকে বলব, এখন আমাকে দিয়ে আপনার চলবে না তবে পেটের বাচ্চা খালাস হয়ে গেলে আমি ভালো রোজগারপাতি করব। আমার চেহারা সুন্দর, গায়ের রঙ ফর্সা। খদ্দের আমার ঘরে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। ভাইজান শোন, আসিয়া যে ফিরে এসেছে তুমি জানো?
আসিয়াটা কে?
আসিয়া কে তুমি ভুলে গেছ? আমাদের কাজের বুয়া। পৃথুর বাবার সহনায়িকা।
ও আচ্ছা!
আমি তাকে বেতন, বেতনের সাথে দুশ টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিলাম। পৃথুর বাবা আজ সকালে তাকে তার বাসায় খবর দিয়ে নিয়ে এসেছে। সে যে আসিয়ার বস্তির বাসার ঠিকানাও জানে তা জানতাম না।
ও আচ্ছা!
কথায় কথায় ও আচ্ছা বলবে না। কোনো কিছুই আচ্ছা না। ভাইজান, একটু একা একা থাক, আমি পৃথুকে একটা চড় দিয়ে আসি।
কেন?
টিভি বন্ধ করে দিয়ে এসেছিলাম, আবার চালু করেছে। বাপ যেমন বদ, ছেলেও সেই পথ ধরবে আমি চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ঠোঁটের উপর গোফ দেখা যাওয়া মাত্র বাবার মতো কাজের মেয়েদের নিয়ে ফস্টিনস্টি শুরু করবে।
পৃথুর কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বেচারা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শামসুদ্দিনের মন খারাপ লাগছে। তিনি চোখ বন্ধ করে পড়ে আছেন। এখন শরীরটা আগের মতো খারাপ লাগছে না। জুর মনে হয় কমতে শুরু করেছে। রাহেলার সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। একবার শুধু শোনা গেছে সে আসিয়াকে বেবীটেক্সি ডেকে আনতে বলছে। আবারো কি ঘর ছেড়ে চলে গেল?
জয়নাল ডাক্তার আনতে পারে নি। ডাক্তার এখন আর হাউজ কলে উৎসাহী না। তবে সে খালি হাতে আসে নি। এক হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে ওষুধ নিয়ে এসেছে। সাগু দানার মতো ওষুধ। তিনবেলা তিন দানা খেলেই নাকি শরীর ঠিক হয়ে যাবে।
শামসুদ্দিন একদানা ওষুধ খেলেন। জয়নাল বলল, ওষুধটা ব্লাড়ে মিশতে দুঘণ্টা লাগবে। দুঘণ্টা পরে দেখবেন আপনি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসেছেন।
শামসুদ্দিন বললেন, ঐ রাতে কী হয়েছিল? তুমি ফিরছই না, আমি খুব দুশ্চিন্তা করেছি।
আপনি দুশ্চিন্তা করেছেন বুঝতে পেরেছি। চাচাজি আমার উপায় ছিল না। ফেঁসে গিয়েছিলাম। আধ ঘন্টার জন্যে গিয়ে ছয় ঘণ্টার জন্যে আটকা। ইতিদের বাড়িতে তো আমি আগেও গিয়েছি। ওদের ড্রয়িংরুমে গিয়ে ফকির মিসকিনের মতো বসে থাকা। বাসি টক চানাচুর দিয়ে চা খাওয়া। ইতির বাবার সঙ্গেও কয়েকবার দেখা হয়েছে। তিনি এমনভাবে চোখ মুখ কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়েছেন যেন আমার সারা গায়ে কাদা লেগে আছে। তাদের সোফাতে কাদা লেগে যাচ্ছে। সালাম দিলেও উনি সালাম নিতেন না। ই বলে শব্দ করতেন।
ঐ রাতে কথা বলেছেন?
ইস্কাবনের টেক্কা আমার হাতে। কথা বলবে না মানে? রাজনীতি নিয়ে কথা, দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা নিয়ে কথা। আমেরিকায় গিয়ে আমি কী করব তা নিয়ে কথা। আমিও মনের সুখে মিথ্যা কথা বলেছি।
মিথ্যা কী বলেছ?
বলেছি–আমেরিকায় দুটা ইউনিভার্সিটিতে অ্যাডমিশন হয়ে আছে। আগে MS করব। আমেরিকায় সেটল করার কোনো ইচ্ছা আমার নাই- সেটল করব নিউজিল্যান্ডে। দেশটা ছোট। মাত্র চল্লিশ লাখ লোকের বস। বাস করার জন্যে অপূর্ব।
জয়নাল মনের আনন্দে হরবর করে কথা বলে যাচ্ছে। শামসুদ্দিনের শুনতে ভালো লাগছে। তার মাথার ভেঁতা যন্ত্রণাটাও মনে হয় কমে যাচ্ছে।
চাচাজি তারপর শোনেন কী অবস্থা–রাতে তাদের সঙ্গে ভাত খেলাম। ভাত খাওয়ার পর কফি। ইতির দাদি থাকেন কমলাপুরে। সেখান থেকে টেলিফোন– উনি আসছেন। রাতে ইতিদের বাড়িতে থাকবেন। আমি যেন তার সঙ্গে দেখা না করে চলে না যাই।
একদিনে তুমি তো মনে হয় অনেকদূর এগিয়েছ।
জি চাচাজি। তিন ঘণ্টা মনের সুখে ব্যাটিং করেছি। প্রতি ওভারে একটা দুষ্ট ছয়ের মীর। আপনার জন্যে খুবই টেনশন হচ্ছিল। আপনি একা বসে আছেন–কী না কী ভাবছেন। এদিকে উঠতেও পারছি না। খেলা এমন জমে উঠেছে–ছক্কার পর ছক্কা মারছি।
তোমার কথা ভালো লাগছে জয়নাল।
শুধু ভালো লাগলে তো চাচাজি হবে না। সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আপনাকেই যেতে হবে। আধমরার মতো বিছানায় পড়ে থাকার টাইম এখন না। এখন হচ্ছে টাইম অব অ্যাকশন। এ সপ্তাহেই আপনাকে নিয়ে সিলেট যেতে হবে।