- বইয়ের নামঃ আজ আমি কোথাও যাব না
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
নাকের ভেতর শিরশির করছে
উৎসর্গ
মানুষ পৃথিবীতে এসেছে পঞ্চ ইন্দ্রিয় নিয়ে। শোনা যায় কিছু মহাসৌভাগ্যবান মানুষ ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নিয়েও আসেন। আমার কপাল মন্দ, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দূরের কথা পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের এক ইন্দ্রিয় কাজ করে না। দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে আমি কোনো কিছুর গন্ধ পাই না। ফুলের ঘ্রাণ, লেবুর ঘ্রাণ, ভেজা মাটির ঘ্রাণ… কোনো কিছুই না।
এদেশের এবং বিদেশের অনেক ডাক্তার দেখালাম। সবাই বললেন, যে নার্ভ গন্ধের সিগন্যাল মস্তিষ্কে নিয়ে যায় সেই নার্ভ নষ্ট হয়ে গেছে। সেটা আর ঠিক হবে না। আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে গন্ধবিহীন জগৎ স্বীকার করে নিলাম।
কী আশ্চর্য কথা, অল্পবয়স্ক এক ডাক্তার আমার জগতকে সৌরভময় করতে এগিয়ে এলেন। দীর্ঘ পনেরো বছর পর হঠাৎ লেবু ফুলের গন্ধ পেয়ে অভিভূত হয়ে বললাম, এ-কী!
যিনি আমার জগৎ সৌরভময় করেছেন, তাঁর নিজস্ব ভুবনে শত বর্ণের শত গন্ধের, শত পুষ্প আজীবন ফুটে থাকুক–এই আমার তাঁর প্রতি শুভ কামনা।
ডা. জাহিদ
————–
০১.
নাকের ভেতর শিরশির করছে।
লক্ষণ ভালো না। তিনি চিন্তিত বোধ করছেন। হাঁচি উঠার পূর্বলক্ষণ! হাঁচি শুরু হয়ে গেলে সর্বনাশ। এই বিষয়ে তাঁর সমস্যা আছে। তাঁর হাঁচি একটা দুষ্টায় থামে না–চলতেই থাকে। তার সর্বোচ্চ রেকর্ড আটচল্লিশ। তিনি ভৈরব থেকে ট্রেনে করে গৌরীপুর যাচ্ছিলেন। আঠারোবাড়ি স্টেশন থেকে হাঁচতে শুরু করলেন, পরের স্টেশন নান্দাইল রোডে এসে থামলেন। তখন নাক দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করেছে। সাদা পাঞ্জাবি রক্তে মাখামাখি।
তিনি এখন যে জায়গায় বসে আছেন সে জায়গাটা হাঁচির বিশ্ব রেকর্ড করার জন্যে উপযুক্ত না। তিনি বসে আছেন দুর্গ টাইপ একটা বারান্দায়। বারান্দায় চৌদ্দটা কাঠের বেঞ্চ। বেঞ্চগুলিতে গাদাগাদি করে মানুষজন বসে আছে। এতগুলি মানুষের জন্যে এক কোনায় দুটা মাত্র ফ্যান। বারান্দার এক দিকে চারটা বন্ধু জানালা। সেই জানালাগুলিও ভারি লোহার শিক দিয়ে আটকানো। অন্যদিকে খুপড়ি খুপড়ি ঘর। ঘরগুলির দরজা খুললে দেখা যায় ঘরের ভেতর আরেকটা ঘর, কাচের দেয়াল দিয়ে আলাদা করা। কাচের দেয়ালের ওপাশে গম্ভীর মুখে আমেরিকান সাহেবরা বসে আছেন। ঘরগুলির নাম্বার আছে। একেক নাম্বারের ঘরে একেক জনের ডাক পড়ছে। ঘরে ঢোকা মাত্র দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ভেতরে কী কথাবার্তা হচ্ছে বোঝার উপায় নেই। মোটামুটি ভয়াবহ অবস্থা। এই অবস্থায় তিনি তাঁর বিখ্যাত ধারাবাহিক হাঁচি দিয়ে সাদা পাঞ্জাবি রক্ত মাখিয়ে লাল করে ফেলতে পারেন না। আজ অবশ্যি তার গায়ে সাদা। পাঞ্জাবি নেই। হালকা সবুজ রঙের ফুল শার্ট পরে এসেছেন।
তার সিরিয়েল তের। এখন সাত নাম্বার যাচ্ছে। ছোটঘরে ঢোকার সময় এসে গেছে। তিনি প্রায় নিশ্চিত আমেরিকান সাহেবের মুখোমুখি হওয়া মাত্র তার হচি শুরু হবে। সাহেব প্রথম কিছুক্ষণ মজা পাবে, তারপর বিরক্ত হবে। কঠিন কঠিন প্রশ্ন শুরু করবে। তিনি হাঁচির যন্ত্রণায় কোনো প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারবেন না। তার ইংরেজিও এলোমেলো হয়ে যাবে। তিনি নিজে ইংরেজির শিক্ষক। ভুল-ভাল ইংরেজি বলা তার জন্যে লজ্জার ব্যাপার হবে। সাহেব জেনারেল নলেজের কোনো প্রশ্ন করবে কি-না কে জানে। আমেরিকার ইতিহাস বিষয়ে দুএকটা প্রশ্ন করলে করতেও পারে। সে বিষয়ে মোটামুটি প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন। আমেরিকার সব প্রেসিডেন্টের নাম, তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনী তাঁর জানা আছে। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনকে যে গুলি করে মেরেছিল তার নাম উইলিয়াম বুথ। সেই সময় আব্রাহাম লিংকন থিয়েটার দেখছিলেন। তাঁর হাতে ছিল একটা উপন্যাস–নাম আংকেল টমস কেবিন। উপন্যাসটা তার পড়া। তবে মূল ইংরেজিতে পড়েন নি। অনুবাদ পড়েছেন। বাংলা অনুবাদের নাম টমকাকার কুটির। নামটা সুন্দর হয়েছে। ইংরেজি নামের চেয়েও ভালো হয়েছে।
প্রথমে কি নাম জিজ্ঞেস করবে? ওদের তো আবার নামের আলেক ঝামেলা আছে। ফার্স্ট নেম, লাস্ট নেম, মিডল নেম। তাঁর নাম শামসুদ্দিন আহমেদ। শামসুদ্দিন ফার্স্ট নেম। আহমেদ লাস্ট। মিডল নেম বলে কিছু নেই। মিডল নেম জিজ্ঞেস করলে কি ডাক নাম বলবেন? তার ডাক নামটা খুব অদ্ভুত। তবে সাহেবদের চোখে অদ্ভুত কিছু ধরা পড়বে না। ওদের কাছে শামসুদ্দিনও অদ্ভুত, আবার আহমেদও অদ্ভুত।
চাচা মিয়া, আপনার সিরিয়েল কত?
শামসুদ্দিন চমকে উঠে দেখলেন তাঁর সামনে অতিরিক্ত রোগা, অতিরিক্ত লম্বা, প্রায় বক পাখি টাইপ একটা ছেলে অতিরিক্ত লম্বার কারণেই কুঁজো হয়ে দাড়িয়ে আছে। সে-ই সিরিয়েল জিজ্ঞেস করছে চাপা গলায় যেন খুবই গোপন কোনো খবর জানতে চাচ্ছে। তিনি আগ্রহ নিয়ে ছেলেটার দিকে তাকালেন। বয়স অল্প, বাইশ তেইশের বেশি হবে না। চোখে চশমা। চশমার ফ্রেম অনেক বড় বলে মুখটা ছোট লাগছে। অল্প বয়সেই বেচারার মাথায় টাক পড়ে গেছে। মাথার এক দিকের চুল লম্বা করে টাকের উপর দিয়ে টাক ঢাকার একটা চেষ্টা
সে চালিয়েছে; তাতে লাভ হয় নি। ছেলেটা আগের মতোই ফিসফিসে গলায় বলল, বসি আপনার পাশে?
সীটটা খালি আছে না?
শামসুদ্দিন বললেন, খালি আছে। বসো।
আগে যেখানে বসেছিলাম সেখানে মাথার উপরে ফ্যান নাই। অন্যসময় গরমে আমার সমস্যা হয় না। কিন্তু টেনশানের সময় গরম সহ্য করতে পারি না। প্যালপিটিশন হয়।