মামা প্রথমবার মুখ খুললো, বলল, “তোর আম্মু আব্বু যেতে দিবে?”
আমার মনে হলো আনন্দে একটা লাফ দেই। অনেক কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিলাম। তারপর বললাম, “সেইটা তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও। আম্মু আব্বুকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার। শুধু তোমাকে যদি জিজ্ঞেস করে তুমি বলবে তোমার কোনো আপত্তি নাই।”
মামা একটা নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর বলল, “ঠিক আছে, তোকে প্রথমে ছোট একটা ট্রিপে নেই, তিন চারদিনের ট্রিপ, দেখি তুই টিকতে পারিস কি না।”
“ঠিক আছে মামা।”
আমি সেই রাতের মাঝে আম্মু আর আব্বুকে রাজি করিয়ে ফেললাম। কিছু কথাবার্তা বানিয়ে বলতে হলো, কিছু বাড়িয়ে চাড়িয়ে বলতে হলো। এবং প্রচুর ঘ্যান ঘ্যান করতে হলো। কিন্তু সেটা তো করতেই হয়। আমার চাইতে ভালো ঘ্যান ঘ্যান পৃথিবীতে কেউ করতে পারে না।
.
ঘুমানোর আগে আমি যখন আমার ব্যাগটা গোছাচ্ছি তখন আপু একটু অবাক হয়ে বলল, “টোপন, তুই নাকি মামার সাথে যাচ্ছিস?”
আমি একটা টি শার্ট ভাঁজ করতে করতে বললাম, “মামা যেতে বলল তার এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য নাকি আরেকজন সায়েন্টিস্ট দরকার। আরেকজন কোথায় পাবে? তাই আমাকে বলেছে, আমি না করতে পারলাম না।”
আপু চোখ কপালে তুলে বলল, “তুই? সাইন্টিস্ট?”
“না। ঠিক সাইন্টিস্ট না। পার্টনার বলতে পার। মামা যখন আমাকে তার সাথে যেতে বলেছে আমি বললাম মামা, এতো জটিল এক্সপেরিমেন্ট, আমি কী পারব। মামা বলল, তুই না পারলে কে পারবে? তোর মতো চালাক চতুর ছেলে আর কে আছে? আমি ভাবছিলাম পরীক্ষা শেষ এখন কম্পিউটার প্রোগ্রামিংটা শিখব। নতুন একটা ল্যাংগুয়েজ বের হয়েছে নাম হচ্ছে সি শার্প। শেখার জন্য এখন দেরী হয়ে যাবে। যাই হোক অন্য অভিজ্ঞতাও হবে। সেটা খারাপ কী? তাই না আপু?”
আপু কথা বলতে পারে না, আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। আমি গলা নামিয়ে বললাম, “মামার প্রজেক্টে পার্টনারের জন্য অনেক টাকা রাখা থাকে। মামা আমাকে সেখান থেকে প্রতি মাসে বেতন দিতে চেয়েছিল। আমি রাজি হই নাই। নিজের মামার কাছ থেকে কেউ টাকা নিতে পারে? কী বল আপু?”
আমি দেখলাম আপুর চোয়ালটা ঝুলে পড়ল। সেটা দেখে আমার বুকটা ভরে গেল আনন্দে!
০৩. মামার মাইক্রোবাসে উঠছি
০৩.
ভোর বেলা যখন রওনা দেওয়ার জন্য আমি আমার ব্যাগ নিয়ে মামার মাইক্রোবাসে উঠছি তখন সবাই আমাকে বিদায় দেওয়ার জন্য নিচে নেমে এলো। মিঠুন তার অভ্যাসমতো কয়েকবার নাকী গলায় বলল, “আঁমিও যাব। ভাইয়ার সাথে আমিও যাব। আঁ অ্যাঁ।” কেউ তার কথাকে কোনো গুরুত্ব দিল না, তখন সে চুপ করে গেল। আপু কোনো কথা না বলে মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি যখন ঠিক মাইক্রোবাসে উঠব তখন আপু জিজ্ঞেস করল, “টোপন, বাথরুম করেছিস?”
আমি গম্ভীর মুখে বললাম, “করেছি।”
“ছোটটা না বড়টা?”
আমি না শোনার ভান করে মাইক্রোবাসে উঠে গেলাম। আম্মু এসে গাড়ির জানালা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে আমার মাথায় শরীরে হাত বুলিয়ে প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, “বাবা সাবধানে থাকিস। সহি সালামতে ফিরে আসিস।” তারপর হাত ধরে বললেন, “ফী আমানিল্লাহ। ফী আমানিল্লাহ।” সব শেষে আরো কিছু দোয়া দরুদ পড়ে আমাকে ফুঁ দিলেন।
আম্মুর কথা এবং ভাবভঙ্গী দেখে মনে হতে থাকে আমি বুঝি পাকিস্তানিদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছি। আব্বু আম্মুর মতো এতো কিছু করলেন না। শুধু গম্ভীর মুখে বললেন, “টোপন। তোর মামাকে বেশি জ্বালাবি না।”
আমি মাথা নাড়লাম, মামা ড্রাইভারের সিটে বসল তারপর হাত নেড়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মাইক্রোবাসটা স্টার্ট করে দিল। আমরা দেখতে দেখতে বাসার সামনের গলিটা পার হয়ে বড় রাস্তায় উঠে গেলাম। এখনো অনেক ভোর তাই রাস্তার দুই পাশের দোকানপাট বেশিরভাগ বন্ধ, রাস্তাও মোটামুটি ফাঁকা। বড় রাস্তা ধরে কিছুদূর এগিয়ে যখন হাইওয়েতে ওঠার জন্য রওনা দিয়েছি তখন আমি তলপেটে চাপ অনুভব করলাম, বুঝতে পারলাম আমার বাথরুম পেয়েছে। মাত্র বাথরুম করে আমি মাইক্রোবাসে উঠেছি কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি আবার বাথরুম পেয়ে গেল? কী আশ্চর্য! আমি জোর করে বাথরুম চেপে বসে রইলাম।
মামা যখন মাইক্রোবাসটা চালিয়ে হাইওয়েতে উঠেছে তখন আমি আবিষ্কার করলাম, শুধু যে বাথরুম পেয়েছে তা নয়। আমার খিদেও পেয়েছে। অথচ গাড়িতে ওঠার আগে আমি রীতিমতো জোর করে জেলি আর মাখন দিয়ে দুই টুকরা রুটি, একটা কলা, একটা ডিম পোচ আর আধ গ্লাস দুধ খেয়েছি। এতো কিছু খাওয়ার পর একজন মানুষের এতো তাড়াতাড়ি খিদে পায় কেমন করে? কী আশ্চর্য!
মামা গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে গাড়ি চালাচ্ছে। মামার গলায় কোনো সুর নাই গানের কথাগুলিও জানে না তাই তার গানের কোনো আগা মাথা নাই কিন্তু সেই জন্য মামার কোনো সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না, মামা বেশ মন দিয়েই গান গেয়ে যাচ্ছে। এক সময় গান থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল “কী খবর টোপন? এতো চুপচাপ কেন?”
আমি তো আর বলতে পারি না, বাথরুম পেয়েছে এবং খিদে লেগেছে তাই একটু অস্পষ্ট শব্দ করে নড়েচড়ে বসলাম। মামা জিজ্ঞেস করল “বাসার জন্য মন খারাপ লাগছে? এখনো সময় আছে বল, গাড়ি ঘুরিয়ে নামিয়ে দিয়ে আসি।”