“তুমি তোমার সাথে কাজ করার জন্য একটা এসিস্টেন্ট খুঁজছ না? আমি তোমার এসিস্টেন্ট হতে চাই।”
মামা তার চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে একটা বিষম খেলো। কাপটা টেবিলে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে কাশতে কাশতে বলল, “অ্যাঁ?”
আমি দ্বিতীয়বার কথাটা বললাম। মামা আমার দিকে তাকিয়ে রইল তার চোখে কেমন জানি অবিশ্বাস। তারপর বলল, “তুই আমার এসিস্টেন্ট হতে চাস?”
“হ্যাঁ।” আমার কথায় যেন কেননা কিছু অস্পষ্ট না থাকে সেইজন্য পরিষ্কার করে বললাম, “আমি তোমার এসিস্টেন্ট হতে চাই।”
মামা আরো কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে রইল এবং এবারে তার মুখে কেমন এক ধরনের হাসি ফুটে উঠল। হাসিটা মোটেও ভালো টাইপের হাসি না। মামা বলল, “তোর কেন ধারণা হলো আমি একটা গেন্দা বাচ্চাকে আমার এসিস্টেন্ট হিসেবে নেব?”
আমি মুখটা যতটুকু সম্ভব গম্ভীর করে বললাম, “তার প্রথম কারণ হচ্ছে আমি মোটেও গেন্দা বাচ্চা না। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে আমি শুনেছি তুমি আব্বুকে বলেছ তোমার এসিস্টেন্ট হওয়ার জন্য টেকনিক্যাল হওয়ার দরকার নেই, চালাক চতুর হলেই হবে। আমি যথেষ্ট চালাক চতুর। তিন নম্বর কারণ হচ্ছে আমাকে নিলে তোমার বেতন দিতে হবে না। তুমি। চাইলে দিতে পার কিন্তু না দিলেও আমি কাজ করব। চার নম্বর কারণ হলো_”
মামা আমাকে বলল, “দাঁড়া আগে এই তিনটা কারণ ভালো করে বুঝে নিই। তুই গেন্দা বাচ্চা না তাহলে তোর বয়স কতো?”
“বারো। আর একটা বছর হলেই আমি টিন এজার হব। টিন এজাররা যথেষ্ট বড়। মানুষেরা টিন এজারদের রীতিমতো ভয় পায়।”
মামা কষ্ট করে মুখের হাসিটা গোপন করল, তারপর বলল, “আর চালাক চতুর তুই চালাক চতুর?”
হ্যাঁ।”
“কীভাবে জানিস?”
“প্রমাণ চাও?”
মামা এবারে একটু অবাক হলো। বলল, “তুই প্রমাণ দিতে পারবি?”
“তোমার পছন্দ হবে কি না জানি না, কিন্তু দিতে পারব।”
মামার মুখে সেই খারাপ টাইপের হাসিটা আবার ফেরত এলো, বলল, “দে দেখি।”
আমি বললাম, “যদি দেখাতে পারি আমি চালাক চতুর তাহলে আমাকে নিবে?”
“আগে দেখা।”
আমি গলা পরিষ্কার করে বললাম, “ঠিক আছে। তুমি কাউকে জানাতে চাও না কিন্তু আমি জানি তুমি একটা পিস্তল নিয়ে ঘুরে বেড়াও। রিভলবার না, পিস্তল। ম্যাগাজিনে আটটা গুলি আঁটে।”
মামার মুখের সেই খারাপ টাইপের হাসিটা অদৃশ্য হয়ে চোয়ালটা কেমন জানি ঝুলে পড়ল। আমি না দেখার ভান করে বললাম, “তুমি ঠিক কী কর সেটাও কাউকে জানাতে চাও না কিন্তু আমি জানি তুমি সারা দেশে ইউরেনিয়ামের খনি খুঁজে বেড়াও।” (মামার চোয়াল এবারে আরো খানিকটা ঝুলে পড়ল।) আমি না দেখার ভান করে বলতে লাগলাম, “ইউরেনিয়াম খুবই মূল্যবান ধাতু। এর একটা আইসোটপ হচ্ছে ইউরেনিয়াম টু থার্টি ফাইভ– এটা দিয়ে বোমা বানায়। (মামার সাথে কথা বলার জন্য এই লাইনটা মুখস্ত করে এসেছি!) তুমি সেই ইউরেনিয়ামের আইসোটপ খুঁজে বের করেছ গামা রে স্পেকট্রোস্কোপি দিয়ে।”
আমি মামার চোখের দিকে না তাকিয়ে বললাম, “তুমি যদি চাও তাহলে আমি গভীর রাত্রে একটা মেয়ে যে তোমাকে বিয়ে করার উপদেশ দিয়েছিল সেই ঘটনাটার কথা বলতে পারি। কিংবা মেহরিন ম্যাডামের কথা বলতে পারি?
এইবারে ফটাশ শব্দ করে মামার স্কুলে পড়া চোয়াল বন্ধ হয়ে গেল। মামা শুকনো গলায় বলল, “তু-তু-তুই কেমন করে জানিস?”
“চোখ কান খোলা রাখলে যারা চালাক চতুর তারা সেগুলো জেনে যায়। আমি জেনে গেছি। সবার সামনে ভান করি কিছুই জানি না। হাবা গোবা একজন মানুষ।
মামা কেমন করে জানি আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, “এখন কী তিন নম্বর কারণটা সম্পর্কে বলব?”
মামা বলল, “না। দরকার নাই।”
‘তাহলে আমাকে নিবে, মামা?”
মামা কিছু বলল না। তখন আমি সর্বশেষ অস্ত্রটা ব্যবহার করলাম। একটু কাছে গিয়ে মামার হাত ধরে খুবই নরম গলায় বললাম, “প্লিজ মামা প্লি-ই-ই-জ। সব মামারা তাদের ভাগ্নেদের কতো আদর করে, তাদের জন্য কতো কিছু করে, তুমি আমার মামা, তুমিও করবে না? এসিস্টেন্ট বানানোর দরকার নাই, তুমি মনে করো আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছি। তোমার সাথে আমি বেড়াতে যাচ্ছি। তুমি আমাকে গল্প বলবে, আমি শুনব। আমি তোমাকে একটুও ডিস্টার্ব করব না।”
মনে হলো মামার মুখটা একটু নরম হলো। আমি তখন গলার স্বরকে আরো মোলায়েম করে বললাম, “মামা, আমি কাউকে কিছু বলব না। কিছু বলব না, খোদার কসম। আমার জন্য তোমার কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমি সব জায়গায় ঘুমাতে পারি, সবকিছু খেতে পারি। দরকার হলে জঙ্গলে বাথরুম করতে পারব। তোমার মাইক্রোবাস আমি পরিষ্কার-পরিছন্ন করে রাখব। তুমি আমাকে যেটা করতে বলবে সেটাই করব, তোমার যন্ত্রপাতি দেখে শুনে রাখব। প্লিজ মামা প্লিজ।”
মনে হলো মামার মুখটা আরো নরম হলো। আমি গলার স্বর প্রায় কাঁদো কাঁদো করে বললাম, “মামা, আমার জীবনে কোনো আনন্দ নাই, এই বাসায় কেউ আমাকে পাত্তা দেয় না (কথাটা মোটামুটি সত্যি), কেউ আদর করে না (কথাটা বানানো), সবাই সারাক্ষণ বকাবকি করে (কথাটা একটু সত্যি একটু বানানো), তোমার সাথে যদি যাই তাহলে কয়েকটা দিন জীবনে একটু আনন্দ হবে। জীবনে কখন কী হয় কে বলতে পারবে? একটু আনন্দ করতে দাও মামা। প্লিজ, মামা, প্লি-ই-ই-ই-ই-ই-জ।”