মামার কথাবার্তা কাগজপত্র কম্পিউটার স্ক্রিনে সবচেয়ে বেশি যে শব্দটা পাওয়া গেল সেটা হচ্ছে ‘ইউরেনিয়াম’। আগে হলে ভাবতাম ফজলী আম ল্যাংড়া আমের মতো ইউরেনিয়াম একধরনের আম। এবারে সেটা ভাবলাম না, একটু ঘাটাঘাটি করে বুঝতে পারলাম যে ইউরেনিয়াম মোটেও আম না, এটা হচ্ছে এক ধরনের মৌলিক পদার্থ (খোদাই জানেন তার মানে কী!) যেটা দিয়ে এটম বোমা বানায়। তখন হঠাৎ করে বুঝে গেলাম মামা কী করছে, মামা পুরো দেশ চষে ফেলছে এই দেশে ইউরেনিয়ামের খনি আছে কীনা সেটা দেখার জন্য। কীভাবে মামা সেটা দেখছে সেই কায়দাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না, এই ব্যাপারে যে বৈজ্ঞানিক শব্দটা ব্যবহার করছে সেটা হচ্ছে ‘গামা রে স্পেকট্রোস্কোপি উচ্চারণ করতেই দাঁত ভেঙে যায়। গামা রে ব্যাপারটা কী ঠিক বুঝতে পারলাম না তবে কিছুদিন আগে একটা দুর্ধর্ষ বই পড়েছিলাম সেখানে যে ভিলেন ছিল সে শত্রুকে হত্যা করতে ডেথ-রে দিয়ে। গামা রে ডেথ রে এর মতো ভয়ংকর কিছু হতে পারে। মনে হয় এক ধরনের অদৃশ্য আলো যেটা শরীর ফুটো করে চলে যেতে পারে।
মামা কী করছে জানার পর মামার সম্মান আমার কাছে আরো একশ গুণ বেড়ে গেল। মামা যদি আসলেই ইউরেনিয়ামের খনি পেয়ে যায় আর আমি যদি সেখান থেকে কয়েক কেজি সরিয়ে ফেলতে পারি তাহলে কী মজা হবে। তাহলে স্কুলের সায়েন্স ফেয়ারে আমি ছোটখাটো এটম বোমা বানিয়ে দেখাতে পারি। সত্যিকারের এটম বোমা বানাতে পারলে নির্ঘাত ফার্স্ট সেকেন্ড হয়ে যাব জীবনেও কোনোদিন কোনো কিছুতে পুরস্কার পাই নাই, সায়েন্স ফেয়ারে পুরস্কার পেলে আমার সম্মানটাও বেড়ে যাবে। আপু কথায় কথায় বলতে পারবে না, অকম্মার ধাড়ী!
.
মামা কয়েকদিন আমাদের বাসায় থেকে আবার তার ভ্রাম্যমাণ ল্যাবরেটরি নিয়ে বের হওয়ার জন্য রেডি হলো। আম্মু কিছু খাবার রান্না করে দিচ্ছেন। মামা জামা কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করে নিচ্ছে, তখন শুনলাম আব্বু মামাকে বলছেন, “আমার কী মনে হয় জান?”
মামা জিজ্ঞেস করল, “কী?”
“আমার মনে হয় তোমার সাথে আরো একজন থাকা উচিত। একেবারে একা একা থাকাটা ঠিক না।”
মামা হা হা করে হাসল, বলল, “আমার সাথে কে থাকবে? বনে জঙ্গলে খেয়ে না খেয়ে থাকতে হয়। মশার কামড় খেতে হয় স্লিপিং ব্যাগে ঘুমাতে হয়, সপ্তাহে একদিন গোসল–
আব্বু বললেন, “সে যাই হোক, তবু একেবারে একা থাকা ঠিক না। আর কিছু না হোক, কথা বলার জন্যও তো একজন লোক দরকার।”
মামা এবারে মুখ গম্ভীর করে বলল, “আসলে আমি নিজেও বিষয়টা ভেবেছি। একজন এসিস্টেন্ট থাকলে খারাপ হতো না। আমার প্রজেক্টে তার জন্য বাজেটও আছে, মাসে মাসে ভালো বেতন দিতে পারব। কিন্তু আমি ঠিক মানুষ খুঁজে পাচ্ছি না। এটা তো আর অফিস স্টাফ না যে কাগজপত্র টাইপ করে দেবে। এই মানুষটা চব্বিশ ঘণ্টা আমার এক দুই হাতের ভিতর থাকবে, ঠিক মানুষ না হলে আমার লাভের বদলে ক্ষতি হবে।”
আব্বু মাথা নাড়লেন, বললেন, “তা ঠিক তোমার আবার সায়েন্টিফিক ব্যাপার স্যাপারের প্রজেক্ট। টেকনিক্যাল মানুষ দরকার, যে এই সায়েন্স জানে। সেটা কোথায় পাবে? এরকম মানুষ পাওয়া মুশকিল।”
মামা বলল, “না দুলাভাই, আমার টেকনিক্যাল মানুষ দরকার নাই, আমার দরকার একজন চালাক চতুর মানুষ যে আমার সাথে থাকবে। সায়েন্টিফিক ব্যাপার স্যাপারগুলো আমি নিজেই দেখব, একজন এসিস্টেন্ট শুধু সাথে থাকবে টুকটাক সাহায্য করবে।”
মামা এই কথাটা বলার সাথে সাথে আমার ব্রেনের মাঝে চিড়িক করে একটা শব্দ হলো, আমার মনে হলো আমি কেন মামার এসিটেন্ট হয়ে যাই না! আমার পরীক্ষা শেষ, এখন স্কুলে যেতে হবে না বহুদিন, আমি যথেষ্ট চালাক চতুর (যদিও বেশির ভাগ মানুষ সেটা জানে না তাদের ধারণা আমি হাবা টাইপের, আমি নিজেও সেরকম ভান করি। আমার জঙ্গলে থাকতে কোনো আপত্তি নাই, আমাকে মশা কামড়ায় না, কামড়ালেও আমি টের পাই না। সপ্তাহে একদিন গোসল আমার মনের মতো কাজ, সত্যি বলতে কী মাসে একদিন গোসল করলেও আমার কোনো আপত্তি নাই, (আপু সবসময় বলে বেড়ায় আমি খবিস, খবিস মানে কী আমি জানি না। ভালো কিছু না এইটুকু আন্দাজ করতে পারি।) স্লিপিং ব্যাগে ঘুমাতে আমার আপত্তি নাই, যে কোনো জায়গায় যে কোনো সময়ে আমি যতক্ষণ ইচ্ছা ঘুমাতে পারি। মামার টুকটাক কাজ আমার থেকে ভালো করে কে করতে পারবে? কিন্তু সেটা সবাইকে কে বোঝাবে? কেমন করে বোঝাবে?
কাজেই আমি ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে শুরু করলাম। প্রথমে মামাকে বোঝাতে হবে যে আমি মামার এসিস্টেন্ট হতে পারব। যদি কোনোভাবে মামাকে বুঝাতে পারি তাহলে আম্মু আব্বুকে বোঝানো খুব কঠিন হবে না। আম্মু আব্বু যদি বুঝতে না চায় তাহলে টানা ঘ্যান ঘ্যান করে যেতে হবে। দরকার হলে আমি খুব ভালো ঘ্যান ঘ্যান করতে পারি।
হাতে সময় বেশি নাই তাই সেদিন বিকেল বেলাতেই মামা যখন একা। তার কম্পিউটারের সামনে মুখ বাঁকা করে বসে আছে তখন আমি হাজির হলাম। কোনো ধানাই পানাই করা যাবে না তাই আমি সোজাসুজি কাজের কথায় চলে এলাম, বললাম, “মামা, তোমার সাথে একটা কথা আছে।”
মামা এক নজর আমাকে দেখল, তারপর আবার কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে তার হাতের চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলল, “কী কথা?”