“এরা একাত্তর সালে আমাদের অনেক জ্বালিয়েছে তাই পৃথিবীর যত খারাপ গল্প, বোকামীর গল্প, গাধামির গল্প সব তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
আমি পিস্তলটা নিয়ে আসার কারণে মামার মেজাজটা অনেক ভালো। মামা মনের খুশিতে বকবক করতে থাকে। বিদেশিটার লাথির কারণে বুকের মাঝে এখনো টন টন করছে তারপরেও আমার মেজাজটাও অনেক ভালো। আমিও মামার বকবকানী শুনতে লাগলাম।
শেষ পর্যন্ত মামার হাতের বাঁধনটা খুলে ফেলতে পারলাম। মামা তার হাত দুইটা কিছুক্ষণ ডলে ডলে রক্ত চলাচল করালো তারপর দাঁতের ফাঁক দিয়ে একটা ইংরেজি গালি দিল। মামাকে আগে কখনো কাউকে গালি দিতে শুনি নাই, তবে এখন মামা গালি দিতেই পারে। আমাকেই যখন এতো খারাপভাবে মেরেছে তখন মামাকে না জানি কত খারাপভাবে মেরেছে। আমি পিস্তলটা মামার কাছে দিলাম। মামা পিস্তলটাকে চুমু দিয়ে ছোট বাচ্চার মতো আদর করল। পিস্তলকে যে আদর করা যায় আমি সেটাও জানতাম না।
আমি মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, “মামা, আমরা এখন কী করব?”
বাইরে তো অনেকগুলো মানুষ এখনই বের হওয়া ঠিক হবে না। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করি, দুই চারজন আসুক, সেগুলোকে বেঁধে ফেলি তারপর বাইরে যাব।”
“কেমন করে বাঁধবে?”
“কেন? যে নাইলনের দড়ি দিয়ে আমাদের বেঁধেছে সেইটা দিয়ে।”
“কিন্তু আগে ধরতে হবে না?”
“ধরব। আমার হাতে একটা পিস্তল, আমার হাতের টিপ মারাত্মক। শুটিংয়ে গোল্ড মেডেল পেয়েছি!”
“আসলেই গুলি করবে?”
“মনে হয় করতে হবে না। ভয় দেখিয়েই কাজ করে ফেলা যাবে।”
“কেউ কী আসবে?”
“আসবে। আসবে। নিশ্চয়ই আসবে।” মামা তারপর ঘরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে গুনগুন করে একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে লাগল, “যদি তার ডাক শুনে কেউ না আসে…”
১২. একটু ঘুম এসে গিয়েছিল
১২.
আমরা কতোক্ষণ বসেছিলাম জানি না। আমার মনে হয় একটু ঘুম এসে গিয়েছিল। হঠাৎ মামা সোজা হয়ে বসে বলল, “কেউ একজন আসছে।”
আমিও সোজা হয়ে বসলাম। মানুষের গলার স্বর শোনা যাচ্ছে তার মানে একজন নয় একজনের বেশি মানুষ আসছে। মানুষ একা একা কথা বলে না।
মামা ফিসফিস করে বলল, “হাত দুটো পিছনে রেখে চুপচাপ বসে থাক। দেখে যেন মনে হয় তোর হাত দুটো এখনো বাঁধা।”
আমি তাড়াতাড়ি আমার দড়িটা লুকিয়ে ফেললাম। তারপর হাত দুটো পিছনে নিয়ে বসে পড়লাম। মুখে হতাশ একটা ভঙ্গী করে মাথাটা এক পাশে কাত করে রাখলাম। মামাও তার দড়িটা পিছনে সরিয়ে হাত দুটো পিছনে নিয়ে রাখল। এক হাতে পিস্তলটা ধরে রেখেছে। মামাও চোখে মুখে খুব একটা হতাশ ভাব ফুটিয়ে রাখল।
আমরা শুনতে পেলাম দরজার বাইরের আলমারিটা ঠেলে সরানো হচ্ছে তারপর দরজা খুলছে। তারপর দুইজন মানুষ ভিতরে ঢুকলো। দুইজন বিদেশি। আমাদের দুইজনের দিকে একবার দেখল, তারপর একটু সরে গিয়ে নিজেদের ভেতর নিচু গলায় কথা বলতে লাগল। আমি স্পষ্ট ক্রসফায়ার শব্দটা শুনতে পেলাম।
মামা খুব ধীরে ধীরে মাথাটা একটু তুলে খুবই ক্লান্ত গলায় ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, “আমাদের নিয়ে তোমাদের পরিকল্পনাটি কী?”
একজন খেঁকিয়ে উঠে বলল, “শাট আপ।”
মামা আস্তে আস্তে মাথা তুলে বলল, “তার মানে আমাদের নিয়ে তোমাদের কোনো পরিকল্পনা নাই?”
মানুষটা আবার খেঁকিয়ে উঠল, “আই সেইড শাট আপ।”
মামা মোটেও হাল ছেড়ে দিল না। খুবই নরম গলায় ইংরেজিও বলল, “তোমাদের যেহেতু কোনো পরিকল্পনা নেই, তাহলে আমাদের পরিকল্পনাটাই কাজে লাগাই। কী বল?”
মানুষ দুটো কেমন জানি চমকে উঠল। মামা তখন পিছন থেকে তার হাতটা বের করে সামলে নিয়ে আসে। তার হাতে চকচকে কালো একটা পিস্তল।
মানুষ দুটো কী করবে বুঝতে পারে না, তাদের মুখ পুরোপুরি হা হয়ে থাকে। একজন ফাঁসাসে গলায় বলল, “ইউ ইউ ইউ” কিন্তু কথা শেষ করতে পারল না।
মামা বলল, “তোমরা একটু খানি তেড়েবেড়ি করলে আমি গুলি করে দেব। আমার কথা বুঝেছ?”
মানুষ দুটি মাথা নাড়ল, মামা বলল, “শুধু মাথা নাড়লে হবে না, মুখে বল, বুঝেছি স্যার। স্যার এর উপর জোর।”
মানুষ দুটি বলল, “বুঝেছি স্যার।” স্যার এর উপর জোর।
মামা এবারে উঠে দাঁড়াল, তারপর বলল, “দুইজন দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়াও। হাত উপরে তুলে।”
মানুষ দুইজন হাত উপরে তুলে ঘুরে দাঁড়াল।
মামা তখন বলল, “টোপন, যা এদের সার্চ কর।”
আমি ইতস্তত করে বললাম, “কেমন করে সার্চ করতে হয় আমি জানি না।”
“প্রথমে পকেটে যা আছে সব বের করে নিয়ে আয়। তারপর শরীরে হাত বুলিয়ে দেখ কোথাও কোনো অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে কিনা। যা।”
আমি তখন পকেটে হাত দিয়ে মানি ব্যাগ, চাবির রিং, টেলিফোন, কাগজপত্র সবকিছু বের করে নিয়ে এলাম। বগলের তলায়, পেটে, পিঠে হাত দিয়ে দেখলাম সেখানে কোনো অস্ত্র লুকানো আছে কি না। কিছু লুকানো নেই।
মামা তখন আবার পিছনে সরে গিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসল। আমিও গিয়ে মামার পাশে বসলাম। মামা পিস্তলটা তাদের দিকে তাক করে রেখে বলল, “এবারে বল দেখি তোমরা কারা। এখানে কেন এসেছ? তোমাদের মতলবটা কী? আমাকে কেন ধরে এনেছ? আমার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, এই বাচ্চা ছেলেটাকে কেন ধরে এনেছ?”
মানুষগুলো কোনো কথা বলল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
মামা ধমক দিয়ে বলল, “কী হলো? কথা বল না কেন?”